কবি কালিদাস চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের আলাপচারিতা

 

মথ: আপনি বহুদিন ধরে কবিতা লিখছেন। 'কবিতা কী' এই প্রশ্ন যদি করি তার কি কোনো উত্তর হতে পারে ?

কবি : এক কথায় 'কবিতা কী' বলা যাবে না। তবুও বলি, কবিতা একটা মিশ্রণ। কবিতার পাঠক কবিতার মধ্যে নাটকীয় উপাদান খুঁজে পান, গল্প, গান, কেউ কেউ প্রবন্ধের উপাদানও খুঁজে পান। এইভাবে মানুষ কবিতাকে ভিন্ন ভিন্নভাবে গ্রহণ করেন। তাই মনে হয়, কবিতা এ-সবেরই একটি মিশ্রিত উপাদান। আর একটা কথা আমার প্রবলভাবে মনে হয় যে, আমাদের ভালোলাগাগুলোর শেষ ভালোলাগাটা হচ্ছে কবিতা।

মথ: আপনার কথায় বুঝতে পারা যাচ্ছে যে কবিতায় পাঠক, একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাহলে সত্তর দশকের বিচারে সাম্প্রতিক কবিতা দুর্বোধ্য, পাঠক থেকে বিচ্ছিন্ন, এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন ?

কবি : ষাটের কবিতা ছিল একেবারেই ক্লিশে। পঞ্চাশের চর্বিত চর্বন। সত্তরে আমাদের বাঙালি মানসিকতায় – আমি পশ্চিমবঙ্গের পটভূমিকার কথা বলছি- একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে। তথাকথিত যে মূল্যবোধ ও সংস্কারগত চিন্তাগুলো ছিল তার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যায়। রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে। এসময় আমাদেরই একটা অঙ্গ বাংলাদেশ পাকিস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। আমরা আবার কিছু ছিন্নমূল মানুষ দেখতে পাই। যখনই কোনো রাষ্ট্রের অঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে সবচেয়ে বিপর্যন্ত নরনারীরা ছিন্নমূল হয়ে গেছে। দেখা গেছে, তাদের একটি তীব্র সাংস্কৃতিক চেতনা গড়ে ওঠে। যে চেতনাকে মূলভূখণ্ডের মানুষ হয়ত সেভাবে স্পর্শ করতে পারে না। তখন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হচ্ছে, জোতদার জমিদার পীড়ন হচ্ছে, আমাদের মেয়েরা সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছে। তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে যাচ্ছে। ফলে রান্নাঘরকে বা অন্দরমহলকে আড়াল করার এতদিনের তথাকথিত সংস্কার ভেঙে গেল। আর ওপাশ থেকে যারা এল তাদের সাথে হল মানসিক বিনিময়। দুই বাংলার বাসিন্দাদের মধ্যে একটা অন্তর্ঘাত হল। সেই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য আহামরি কিছু সাহিত্য সৃষ্টি হয় নি। তবে একটা পরিবর্তন নিঃশব্দে হয়ে গেল। আসলে তখনকার সামাজিক পাস্পেকটিভটাই এত অগ্নিগর্ভ ছিল যে সে সময়ের যে কোন সৃষ্টিই আর পাঁচটা সৃষ্টি থেকে আলাদা হত। সেই সময়টাই সেটা করিয়ে নিত। সেভাবে দেখলে নব্বই এর কোনো সাধারণ পারস্পেকটিভ নেই। নেই কোনো মানদণ্ড যার বিচারে আমি বলতে পারি অন্যান্য দশক থেকে নব্বই এর কবিতা আলাদা।

মথ: নব্বুই বা তার পরবর্তী সময়ের কবিতায় গ্লোবালাইজেশনের প্রভাব স্পষ্ট। সত্তর-এর অ্যার্নাকিষ্ট মানসিকতা থেকে যা সম্পূর্ণ আলাদা। আন্তর্জাতিক বোধই কি এই সময়ের বাংলা কবিতার চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য নয়?

কবি : সত্তর-এ একটা অ্যার্নাকিষ্ট মানসিকতা ছিল। ঠিক। নীলিমা এবং নৈরাজ্য। শক্তির কবিতা। সেই নৈরাজ্য শেষ পর্যন্ত আর নৈরাজ্য থাকেনি। নিহিলিজমে রূপান্তরিত হয়ে ছিল। আর এই সংক্রমণ অ্যালিনিয়েসনের জন্ম দিল। বিচ্ছিন্নতা। অর্থাৎ কবিতা কবিরাই পড়বে। পাঠক তৈরির দিকে কবি বা প্রতিষ্ঠান কারও লক্ষ্য ছিল না।

আমাদের সমস্ত পরিকাঠামোই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। শিল্প-সাহিত্য ও তার বাইরে নয়। সত্তর-এ আমরা রাষ্ট্র থেকে বিমুক্তি চেয়েছিলাম। কারণ রাষ্ট্রও একটি শোষণ যন্ত্র। সে শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, মানুষ সমস্তকেই শোষণ করে। কিন্তু রাষ্ট্র থেকে বিমুক্তি সম্ভব হল না। নববই-এ গ্লোবালাইজেশন বা আরো অনেক ব্যাপার হয়তো আসছে, কিন্তু কেমন যেন হজম হচ্ছে না। আর তাই পাঠক থেকে বিচ্ছিন্নও হচ্ছি। তাই পাঠক মাত্রই যে অজ্ঞতা বঙ্কিমচন্দ্রের আমলে ছিল, সেই অজ্ঞতা আজও রয়ে গেছে।

মথ: প্রতিষ্ঠানমুখীনতার জন্য কবিতা সহজ ও ছন্দে ফিরছে। প্রতিষ্ঠানমুখীনতা থেকে এটাই কি আমাদের একমাত্র পাওয়া? নাকি প্রতিষ্ঠানমুখীনতার জন্যই আমরা ইদানিং কবিতায় সর্বহারা?

কবি : একটা কথা খুব পরিষ্কার করে বলা ভালো যারা শিল্প সাহিত্য চর্চার সাথে যুক্ত তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাই অ্যান্টিএস্ট্যাবলিশমেন্টের। এই কারণেই তারা অন্যদের থেকে আলাদা। প্রতিষ্ঠান যখনই কোনো কবিকে হাইলাইট করে তখন তাকে আলাদা অস্তিত্ব না ভেবে একটা উৎপাদন যন্ত্র হিসাবে দেখে। যেটা কমিউনিজম জমানায় হয়েছিল।

মথঃ ইদানিং বলা ভালো নব্বই-পরবর্তী কবিরা একটু বেশিই প্রতিষ্ঠানমুখী হয়ে পড়ছে। এটা কেন হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?

কবি : এটা নব্বই-এর একটা ট্রেন্ড। এইসময়ের যারা তরুণ তারা আপাদমস্তক ক্যারিয়ারিষ্ট। ফলে নব্বই-এর যারা লেখালেখির সাথে যুক্ত তারা এই প্রবণতা অনুসারেই ক্যারিয়ারমুখী হবে। তার জন্য তাকে প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়ার কাছে যেতেই হবে। এটাই স্বাভাবিক।

মথ : শুধু নব্বই বা তার পরবর্তী কবিরা নয় সত্তর-এর কবিরাও এখন প্রতিষ্ঠানমুখী হয়ে পড়েছে। এই প্রবণতা কেন?
 

কবি : এখন হচ্ছে। সত্তরকে কিন্তু সেইসব প্রতিষ্ঠান গ্রাস করতে পারে নি। আবার একজন কবির প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে তাঁর টেবিলটা। কবি টেবিলের একধারে বসে অন্যধারের পৃথিবীকে তাঁর লেখা ছুঁড়ে দেন। এইভাবে ছুঁড়তে ছুঁড়তে কবি দেখলেন তাঁর লেখা কোথাও পৌঁছায় নি। তাঁর কথা কেউ শুনছে না। সময় শুধু যে দ্রুত পাল্টাচ্ছে তাই নয় সঙ্গে সঙ্গে ফুরিয়েও আসছে। তাঁদের মনে তৈরি হচ্ছে এক হতাশার বোধ। এই হতাশা আর আমাকে একটি কীর্তি রেখে যেতে হবে। এই বাসনাতাড়িত হয়ে কিছু লোক, লোক বলাই ভালো কবি নন, তাঁরা স্যারেন্ডার করছেন।

মথ : তাহলে আপনি সত্তর-এর যে বৈপ্লবিক চিন্তাধারার কথা বললেন সেই চিন্তাধারার গোড়ায় গলদ ছিল না কি? তা না হলে সত্তরের এত সংখ্যক কবি কেন প্রতিষ্ঠানের আওতায় চলে আসবেন?

কবি: না। এভরিথিং ইজ গুড এ্যাজ ইট কামস ফ্রম দ্য হ্যান্ডস্ অফ অথার অফ নেচার। এভরিথিং ডিজেনারেটস্ ইন দ্য হ্যান্ডস অফ ম্যান।

মথ : তাই তো বলতে চাইছি যে ওটা নিশ্চয় 'ন্যাচারাল' ছিল না।

কবি : অবশ্যই ন্যাচারাল ছিল। তাদের যে আবেদন, আন্দোলন সেটা সহজাত ছিল। পরবর্তীকালে সেটাকে ভাঙা হলো। সব আন্দোলনের ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার আবেদন কমে যায়। আসলে আমরা তো রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করতে পারি নি। আর তাই প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র তার কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর। যেসব ফ্রেম তার অস্তিত্বের পক্ষে বিপদজনক, সেইসব ফ্রেমকে সে ধ্বংস করতে চেষ্টা করবেই। এই ধ্বংস প্রক্রিয়ার দুটি পথ। এক, সরাসরি নির্মূল করা। দুই, নিজের দলে টেনে নেওয়া। সেটাই হচ্ছে।

মথ : পোষ্টমডার্ন কবিতা এখন ভীষণভাবে শিরোনামে। এই সম্পর্কে আপনার ভাবনা কি?

কবিঃ পোষ্টমডার্ণিষ্ট যারা, তারা বলছেন বটে কবিতায় কোনো কেন্দ্রবিন্দু থাকবে না, কোন নির্ণায়ক সত্য থাকবে না, মিল থাকবে না ইত্যাদি ইত্যাদি, তবে আমার মনে হয় কোনো গোষ্ঠীর ইসতেহার কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। চাপিয়ে দিলে মানুষ নেয় না। এভাবে কবিতা লেখা যায় বলে আমি মনে করি না। একটা ব্যক্তিগত ঘটনার কথা বলি। একসময় আমি খুবই ফ্রাস্ট্রেটেড্ ছিলাম এবং তখন আমি খুবই বাজে জীবন যাপন করতাম। তখন আমার বিশ্বাস ছিল জীবনে হারাকিরি করা ছাড়া গতান্তর নেই! সেই সময় এক অগ্রজ কবি আমাকে রাত্রিবেলা বন্ধ ঘরে বসে জীবনান্দের 'বোধ' কবিতাটি পড়ে শোনান। আমি সেই রাতে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলাম ছেলে-মানুষের মতো। ঐ বোধ কবিতাটি কি কোনো তত্ত্ব দিয়ে লেখা হয়েছিল বা আমি কি কোনো তত্ত্ব বিচার করে প্রাণিত হয়েছিলাম? কোনো কবিই কখনো কোনো তত্ত্বের ড্রাগ নিয়ে সচরাচর কবিতা লেখেন বলে আমার মনে হয় না।

মথ : তাহলে কি এসব তত্ত্বের কোনো প্রয়োজন নেই?

কবি : এটা বলা যায় না। এটা কারো কারো বিশ্বাস। তাদের আছে নিজ নিজ মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর আমার আছে গ্রহণ বর্জনের স্বাধীনতা। সাধারণতঃ আমি এসব থেকে দূরে থাকতে চাই। আমার ব্যক্তিগত মত হল এগুলি পড়ব বুঝবো গ্রহণ করব না। আমি আমার জীবন দিয়েই আমার কবিতা লিখি। আমার সেই লালিত, বিশ্লেষিত এবং পরীক্ষিত জীবনধারার সাথে যদি কোনো তত্ত্ব বা প্রক্রিয়া মেলে তবেই আমি সেটা গ্রহণ করি নচেৎ বর্জন করি।

মথ: মানুষের জীবনের যৌনতার সীমা আমাদের জানা নেই। কবিতায় যৌনতার কি কোনো সীমা আছে?

কবি : জনন মৈথুন মৃত্যু এই তিনটেই তো বিষয়। এর একটাকে তুমি বাদ দেবে কি করে? তুমি শরীরে যৌনতাকে অতিক্রম করতে পারছ না, তাই সাহিত্যেও এটাকে অতিক্রম করা অসম্ভব। তুমি যত রকম পরীক্ষা শরীরের মধ্যেই করতে পারো। শরীরকে বাইরে রেখে কোনো তত্ত্ব কোথাও তৈরি হয় নি। আমাদের জীবনে যৌনতা অনিবার্য। এর কোনো সীমা নেই। একে বর্জন করা যায় না।

মথ : আপনার সময়ের কোন কবির লেখা আপনার ভালো লাগে বা লাগতো?

কবি : আমার জয় গোস্বামীর কবিতা ভালো লাগে। ভালো লাগে রণজিত দাসের আর পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতা। প্রদীপ বসুর কবিতা খুব ভালো লাগতো। নিশিথ ভড় ও দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাও খুব ভালো লাগতো।

মথ : সাম্প্রতিককালের কোন কবির কবিতা আপনার ভালো লাগে?

কবি : ইনডিভিজুয়াল কোনো কবির কথা সেভাবে আমার মনে আসছে না। কারও কারও কিছু কিছু কবিতা ভালো লাগে। নাম করবো না। .......ইন্‌স্‌পায়ার করার কথা বোলো না। কাউকে ইন্‌সপায়ার করার ঠিকা আমাকে কেউ দেয়নি। আমি নিতেও চাই না।

মথ : তাহলে এটা কি আমরা ধরে নিতে পারি যে, সাম্প্রতিককালের কবিদের কবিতা আপনি পড়েন না?

কবি : তোমাদের ইচ্ছে । যা খুশি ধারণা করার অধিকার তোমাদের আছে

 

No comments

Powered by Blogger.