শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী


লকডাউনের ডাইরি
(একাংশ)

 

১.

এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ।

মধ্যরাত পেরিয়ে ঠিক যখন আমার দমবন্ধ হয়ে আসছিল

আর একটা কোকিলা একটানা নৈঃশব্দ্য ফাটিয়ে কুসুমের মত বের করে আনছিল

সারাদিন কিচ্ছু খুঁটে খেতে না পাওয়ার খিদে -

ঘড়ির কাঁটা, শব্দে জোরালো হতে হতে কুঠার হয়ে উঠছিল,

আমি বিশালকায় জানলায় মুখ বাড়িয়ে পাংচার সারানোর মতো করে

চেষ্টা করছিলাম দমবন্ধ সরিয়ে নেওয়ার।

আর ঠিক সেইসময়, তোমার সদ্যজাত হাইকু

ভেসে উঠছিল নতুন মুগ্ধতার স্ক্রিনে -

রান্নাঘর উপচে মজুত ছিল বস্তাভরা আগামীদিনের ভরসা।

 

এই দুটি ঘটনার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।

কোনো সম্পর্ক নেই বলেই এ'দুটি ঘটনা রয়েছে। 

 

 

২.

এই আধাবন্ধ কিংকর্তব্যবিমূঢ় শহরে ইদানিং

বিপদভঞ্জন ধোঁয়ায় ভরে যায় গলির সংসার।

বহুদিন হয়ে গেল ধোসাওয়ালা ছুটির ঘণ্টা দেয়নি -

সন্ধে করে বাসি আনাজের ঝুড়ি থেকে দুয়েকটি বৃদ্ধ বরবটি

উঁকি মেরে দেখে নেয় অদ্যই শেষ রজনী কিনা।

নিয়নের মনোযোগ পেলে মর্চেধরা গ্রিল হেসে ওঠে -

তার দেহের স্তব্ধ ভাঁজে পড়ন্ত যৌবন খেলে যায়।

একঠায় ভার বইতে বইতে রাস্তার শরীর ভেঙে এসেছে

তার এ'সব বালখিল্য লাগে;

তবু সে বিবশ এত, পাশ ফিরে শুতেও পারে না।

 

 

৩.  

ছিনে জোঁকের মত মা'কে নিয়ে দুঃস্বপ্ন

লেগে থাকে - ঘুমের গায়ে।

মা ফোন ধরে, নুনের মত ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয় তাতে।

তবু ফের জন্মায় ওরা - মগজে বংশবৃদ্ধি করে,

নিরাপত্তাহীনতা খেয়ে বাঁচে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি -

গাছের গায়ে মায়া শুকিয়ে আসার দাগ ঘন হয়ে আসছে;

মধ্যরাত পার হলে পেছনের চিলতে গলি দিয়ে ওরা
আবার এসে জমতে শুরু করবে

সারিসারি, জবুথবু, অপ্রস্তুত টেম্পোর আশেপাশে।

ওদেরকে পরিযায়ী বললে, আমারও সংসার টলে যায়।

'সময়ে, বরাভয় সিকিউরিটি গার্ড, ঢুলে পড়ে টেবিলের স্নেহে।

তার কাছে সামান্য কিছু শুকনো আশ্বাস রাখা আছে

কি জানি তা কতদূর যাবে!

 

 

৪.

শহর বদলে গেলেও ছেড়ে যাওয়া বদলায় না।

আলোর ইশারা নিয়ে বিড়ালজননী তার সংসার মেলেছে

প্রতিবেশী কার্ণিশের গায়ে, অবেলায় -

হলুদ রৌদ্রের স্নেহ বুকে পিঠে কানের লতিতে নিয়ে

চেখে দেখছে সদ্য চোখফোটা মায়ার পশম।

এই স্যানিটাইজারময় বিপদবিশ্বের সীমা ওদেরকে ছুঁতে পারেনি।

ছুঁয়ে আছে যেটুকু আলোমাখামাখি আদরজীবন

এই বিকেলের মোহ ধীরে ধীরে পড়ে এলে পরে

সেটুকুও ছেড়ে চলে যাবে। তবু,

ওদের কোনো দুঃস্বপ্ন নেই রোদ্দুর হারিয়ে ফেলা ছাড়া।  

 

 

৫.

 জীবাণুসন্ত্রাসের দিন ফুরিয়ে আসলেও

নিয়নবাতির নীচে চুমু খাওয়া হবে না তোমাকে।

মুঠোভর্তি চুল টেনে ধরে আদুর ত্বকের নীচে

আমার নাব্যতা বুঝে নেওয়া - হবে না তোমারও।

চশমার স্পষ্টবিশ্ব থেকে আমাকে পৃথক করে নেবেনা তুমি

আবছায়া পর্দা-সিল্যুয়েটের গভীর খেলায়।

 

জীবাণুসন্ত্রাসের দিন ফুরিয়ে আসলেও

কিছু ঝরে যাওয়া থেকে যাবে।

 

 

                                                                                                                                                                          ছবি - অর্ণব বসু 

 

No comments

Powered by Blogger.