সৌমনা দাশগুপ্ত

আমার কবিতাভাবনা


সমস্ত লবণ আমি হারিয়ে ফেলেছি

কীভাবে তোমাকে লিখি বাংলাভাষা...

 

এই যে আমি বা আমরা লিখে চলেছি, কেন লিখে চলেছি, কিসের তাগিদে বা কার প্ররোচনায়, তার উত্তর অন্তত আমার জানা নেই। শুধু জানি এ এক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধ, যা অলৌকিক আঠার মতো আমাকে জড়িয়ে রেখেছে, তার থেকে নিস্তার নেই কোনো। যা কিছু ভালোলাগা, ভালোবাসা, ঘৃণা ও যন্ত্রণার, তাকেই অনুবাদ করতে চেয়ে প্রতি মুহূর্তে টের পাই, অলৌকিক ভূদৃশ্য লিখবার এ এক দুরারোহ প্রয়াস। এ যেন চেতন ও অবচেতনের মধ্যে যাতায়াতের একটা সুঁড়িপথ। বাস্তবের দেখা এবং না-দেখাকে, ধরা এবং অধরাকে কিছুটা হলেও ছুঁতে পারা। মাঝেমাঝে মনে হয়, এ যেন এক প্রবাহ, বয়ে নিয়ে চলেছে সেই প্রথম ধারাকে- ঋগ্‌বেদের সেই আদি স্তোত্রটিকে তার শিরায় ধমনিতে ধারণ করে চলেছে উত্তর শতকের দিকে। সমুদ্রঘামের ঢেউ বাজে, তার কাঁপা স্বর লবণ লবণ, আর কবি যেন সেই সল্টলিকে জিভ রেখে শিউরে উঠছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী।   

 

আসলে এই যে বিরাট বিশাল বিশ্বপ্রকৃতি, তার মধ্যে কোথায় আমার অবস্থান, এই খোঁজ তো সেই কোন কাল থেকে মানুষ করেই চলেছে। এখানে কিন্তু মানুষ একা। এখানে তার সম্পূর্ণ কথোপকথন নিজের সঙ্গে। এটাও কি ঠিক নয় যে, আমরা সারাদিনে যত কথা বলি, তার বেশিটাই বলি নিজের সঙ্গে? আর এই স্বগতোক্তি বা সলিলকির থেকেই উঠে আসে কবিতা, অন্তত আমার কবিতা।

 

মনে হয়, এ যেন এক পরিত্রাণহীন যাপন। দরজা-জানলাহীন ঘুপচি একটি ঘর, ঘাড় সোজা করতে গেলেই সিলিং-এ ঠুকে যাচ্ছে মাথা, আর সে টের পাচ্ছে, মেরুদণ্ড বেঁকিয়ে বসে থাকতে থাকতে তার পিঠের ওপর গজিয়ে উঠছে একটি কুঁজসে কুঁজই বলো, আর বর্মই বলো, কাছিমের খোলের মতন শক্ত ও দুর্ভেদ্য এই আস্তরণ তাকে আরও গুটিয়ে আনছে, কেন্নোর মতো গুটিয়ে থাকতে থাকতে সে শুধু চোখ পেতে দিচ্ছেযেন এক মৃত তারা ফিরে যেতে চাইছে তার হারিয়ে ফেলা জল ও মৃত্তিকার কাছে, তার হারিয়ে ফেলা আলোর কাছেসে কি আসলে সেরে ফেলতে চাইছে তার নিজেরই তর্পণ, সে কি আসলে তার ছেঁড়া ছেঁড়া ছাইয়ের টুকরোগুলো জোড়া দিয়ে বানাতে চাইছে এক আদিগন্ত শাড়ি! কোলাজ তৈরি করতে বসে শুকিয়ে যাওয়া আঠার ভেতর সে খুঁজে ফিরছে ঘাম ও রক্তের গন্ধ, প্রেম ও বমির গন্ধ, তারছেঁড়া একটি গিটারএই তো একজন কবির বেঁচে থাকা।


একটা প্রশ্ন বারবার আমাকে বিব্রত করে তোলে, ঝড় তোলে চিন্তায় মননে-- আমরা কি প্রতিটি মুহূর্তে একটা  যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি না! তারপরই মনে হয়, না, যুদ্ধ নয়, একটা মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার  মধ্যে দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি এক ফসিলজীবনের দিকেসচেতন মন বলে, এটাই বাস্তব, গা ভাসিয়ে দাও, এই অতিউজ্জ্বল এলইডি আলো তোমাকে ডাকছে, দ্যাখো, তোমার ঘরের বাইরেই কত আনন্দ আয়োজন, এই মাদক তোমাকে টান দিচ্ছে, পান করো আকণ্ঠ, ডুবে থাকো, ভুলে থাকোআর অবচেতন ভেতরে ভেতরে আমাকে নাড়া দেয়, তার মন্থনদণ্ড এক তীব্র আলোড়ন তোলে, ঘেঁটি ধরে নিয়ে যায় পুঁজিবাদ ও পণ্যায়নের অভিঘাতে ভ্রষ্ট সমাজের দিকে, অস্তিত্বের সংকটের দিকেমনে হয় কোনো একদিন একটা খুব ঠাণ্ডা, খুব অন্ধকার ঘরের ভেতর মরে পড়ে থাকব আমি, আমরাতারপর বুঝতে পারি, ‘থাকবশব্দটা মুছে গেছে, ভবিষ্যৎকাল নয়,  বর্তমানের  অভিঘাতে ঢেকে যাচ্ছে ভবিষ্যৎথাকবশব্দটা হয়ে উঠছেআছিমৃতদের শ্বাসপ্রশ্বাসে ভিজে যায় চরাচর

 

গ্রাফপেপার বেয়ে উঠে যাচ্ছে একখানি মৃতরেখা। মাথার ভেতর শুধু ফ্ল্যাশব্যাক। হতে পারে সেই ছবি সাম্প্রতিক, হতে পারে বহুদূর অতীতের কোনো স্মৃতিসে এক দুরারোগ্য অসুখের মতো ঘাপটি মেরে ছিল মস্তিষ্কের গহিন  কোটরেতারপর একদিন যখন ঢাকাচাপা দিয়ে আর কিছুতেই সেই ব্যাধিকে আটকে রাখা যাচ্ছে না, ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে জমে থাকা বদরক্ত, পুঁজ আলগোছে পড়ে থাকা একটা হাতবোমার আকস্মিক বিস্ফোরণের মতো সে আসে, বায়ুস্তর ছিন্নভিন্ন করে গলগল করে বেরিয়ে আসে লাভাস্রোত, তখন একটা শাদা পাতার কাছে যেতে হয়, এঁকে ফেলতে হয় সেই উন্মোচনের ছবিশুধু আমি আর সেই শাদা পাতা আদিম পুরুষ ও নারীর মতো পরস্পরকে জড়িয়ে আছি আর চূড়ান্ত সঙ্গমে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছি    

 

এইভাবে একটা লেখা তৈরি হওয়ার পেছনে কিছু কাহিনি, কিছু স্মৃতি, কিছু অনুভূতি বা মুহূর্ত থেকেই যায়আর কবি সেইসব অসহায়তা থেঁতো করে, মাটি ঘষে, পাতা ছেঁচে, ফুল পিষে, ময়ূরের পালক, হাঁসের ধবল ডানা, কবুতরের বুকের ওম থেকে তৈরি করেন ভেষজ রংসেই রং কখনও পরম মমতায়, কখনও তীব্র ঘৃণায়, কখনও বা বারুদবমির মতো বিস্ফোরক হয়ে ওঠে তাঁর ক্যানভাসে, তামার পাতে, গুহার দেয়ালে, পাথরের শরীরেহতে পারে সেই বার্তা সরাসরি, আবার রূপক-চিত্রকল্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সেই ভাবনাপাঠক খুঁজে নেন তাকেআর কবি দৌড়োচ্ছেন শুধুই দৌড়োচ্ছেন সেই চূড়ান্ত কমলালেবুর দিকে, তিনি জানেন না সেই রং-কে কোনোদিন তিনি ছুঁয়ে ফেলতে পারবেন কিনা, তবু অনন্তের দিকে তাঁর এই দৌড় আর শেষ হচ্ছে না, হরিণ লিখতে লিখতে কবি একের পর এক গ্যালাক্সি পেরিয়ে ছুটেই চলেছেন

 

                                                                                                                         ছবি - অর্ণব বসু  

 


No comments

Powered by Blogger.