আন্তোনিও মাচাদোর কবিতা অনুবাদঃ শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

 

ক বি  প রি চি তি 


আন্তোনিও মাচাদো স্পেনের সেবিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ২৬শে জুলাই, ১৮৭৫। তাঁর পূর্ণ নাম হলো আন্তোনিও সিপ্রিয়ানো খোসে মারিয়া মাচাদো রুইস।

১৮৮৩ সালে তিনি নিজের পরিবারসহ মাদ্রিদে বসবাসের জন্য চলে আসেন, যেখানে তিনি লিব্রে দে এনসেনিয়ানযা নামের একটি ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করেন। কৈশোর থেকেই তিনি থিয়েটার, ছবি আঁকা, সাংবাদিকতা ও ষাঁড়ের লড়াই-এর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। লাইব্রেরীগুলিতে হাজিরা দেবার সময়, (বিশেষত ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে) লোপ দে ভেগা-এর প্রতি তাঁর আকর্ষণের শুরু। ১৮৯৫ সালে নিজের ভাইয়ের সঙ্গে তিনি একটি সংবাদপত্র “লা কারিকেচুরা”-তে কাজ শুরু করেন যেটি সেই বছরই প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যে স্পেনের নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হয়ে (কিউবার কাছে অধিকার হারানো এবং আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ) মাচাদো ভাইয়েরা প্যারিসে রওনা দেন, যেখানে তাঁরা “খামিয়ার হাউস”-এ অনুবাদক হিসাবে কাজ শুরু করেন। তাঁরা সাক্ষাৎ পান রুবেন দারিও, যিনি ছিলেন বুয়েনাস আইরেস-এর “লা নাসিওন” পত্রিকার সাংবাদিক এবং স্বনামধন্য লেখক অসকার ওয়াইল্ডের, যে দুজনই তাঁর কবিতার প্রশংসাসূচক সমালোচনা করেন। কনসুলেট অফ গুয়াতেমালার চ্যান্সেলর হবার পর তিনি মাদ্রিদ ফিরে আসেন এবং “সোলেদাদেস” প্রকাশ করেন। সে বছরই (১৯০৩) মহৎ সাহিত্যগুণ সম্পন্ন “হেলিওস” ম্যাগাজিনটি প্রকাশ পায় কিন্তু খুবই কম সময়ের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০৭ সালে মাচাদো সোরিয়া-তে প্রফেসর হিসাবে যোগ দেন যেখানে তিনি ফরাসী শেখাতেন আর সেই একই বছরে তিনি প্রকাশ করেন “Soledades, Galleries and other poems” নামে কবিতাগ্রন্থটি। ১৯০৯ সালে চৌঁত্রিশবছর বয়সেতিনি বিয়ে করেন তিনি যে বোর্ডিং-এ থাকতেন তার মালিকের মেয়ে ষোড়শী কিশোরী লেওনর ইসকিয়েরদো কুয়েভাস-কে। ১৯১১ সালে তিনি “Junta de Ampliación de Estudios” থেকে জলপানি পান নিজেকে ফরাসী ভাষা ও সাহিত্যে নিখুঁত করে তোলার জন্য। ১৯১২ সালে প্রকাশিত ও বানিজ্যিকভাবে প্রভূত সফল হয় তাঁর “কাম্পোস দে কাস্তিইয়া”। কিন্তু এই সমৃদ্ধি সত্ত্বেও আন্তোনিও-কে দেউলিয়া হতে হয় ১লা আগষ্ট, ১৯১২-তে, গুরুতর অসুস্থতার পর যখন তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়, যে অসুস্থতায় সেবার জন্য ও আরাম দিতে অন্তোনিও তাঁর স্ত্রীর পাশেই ছিলেন। এই আঘাতই আন্তোনিও-কে বায়েজা (আন্দালুসিয়া)-তে চলে যেতে শক্তি জোগায়, যেখানে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে দর্শন আর গ্রীক শেখেন নিজের দার্শনিক জ্ঞান পূর্ণতর করতে, এবং একই সঙ্গে দর্শনে মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জনের জন্য।

১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কবিতাগ্রন্থদ্বয় “সিলেক্টেড পোয়েমস”ও “কমপ্লিট পোয়েমস”; ১৯২৪ সালে “নিউ সংগস”। ১৯২৬ সালে দুই ভাই আন্তোনিও ও মানুয়েল-এর লেখা নাটক আসে। ১৯২৭ সালে প্রথম জন রয়াল স্পানিশ একাডেমির পূর্ণ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৩১ সালে আবার চলে আসেন মাদ্রিদ, ফরাসী সাহিত্যের চেয়ার পদের জন্য। আন্তোনিও “এল সল” কাগজের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেন যেখানে তিনি তাঁর সৃষ্ট চরিত্র মাইরেনা’র শিক্ষা্মূলক রোমাঞ্চ-কাহিনী প্রকাশ করেন। ১৯৩৬-এ মাদ্রিদে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে থাকার সময় গৃহযুদ্ধ বাঁধে। মানুয়েল সাময়িক সময়ের জন্য বার্খোশে যান কিন্তু তারপর আর পরিবারকে দেখতে পাননি তিনি। আন্তোনিকে মা-সহ শহর ছেড়ে বার্সেনোলা, সেখান থেকে ভ্যালেন্সিয়া এবং সেখান থেকে রোকাফোর্ট-যাত্রা করতে হয়। এ সময়েই তিনি তাঁর শেষ বই “দ্য ওয়ার” প্রকাশ করেন। এই নরক থেকে মাকে নিয়ে ফ্রান্সে পালিয়ে এলেও দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কবি মারা যান ২৩শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৯, তার তিনদিন পর মা মারা যান। আন্তোনিও মাচাদো প্রজন্ম ’৯৮-এর অংশআর সেরকমই একজন ভাবুক এবং স্বপ্নপ্রবণ মানুষ। তিনি স্বভাবতঃ নীরব, প্রত্যাহৃত, অসহ সময়ের ভারে পীড়িত এবং স্পেনের ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত এক ব্যক্তি।

উনামুনো তাঁকে নিম্নলিখিতভাবে বর্ণনা করেছেনঃ

“শরীরে সবচেয়ে অসাবধানী এবং আত্মায় সবচেয়ে পবিত্র, এমন কজন মানুষকেই বা আমি চিনি?”

বেকার-এর গুণগ্রাহী যাঁকে তিনি"poeta lírico, sin retórica" (অলঙ্কারহীন গীতিকবি) বলেছেন, সেই আন্তোনিওর রোমান্টিকতা জুড়ে থেকেছে সন্দেহবাদ, অসন্তোষ, যাঁর আসল সন্ধান ছিল শান্তি ও নির্লিপ্তির। তাঁর কবিতার উৎস ছিল প্রেম, যন্ত্রণা, যুদ্ধ, অস্তিত্বের ক্ষণস্থায়ীত্ব, সর্বোপরি স্পেনের জন্য ভাবনা।

আসুন পাঠক, পড়া যাক, তাঁর কিছু কবিতা।

 


আলো

মূল কবিতাঃ লুস


তোমার হৃদয় কি বাতাসে হার্প হবে?

কোন ধ্বনি বাজায় বাতাস?

ঘৃণা বয় আর মন বাজে

মনকে বাজাও, কেঁপে ওঠো।

নিজের মনকে আজ দয়া করো কবি

তুমি বোধকরি অভিনেতা, ফাঁপা এই মুখোশ-প্যারেডে?

ওরা কি তোমার মুখে ধ্যাবড়ানো সত্যের অশ্রু মুছে দেবে না?

তোমার বুক কি হাসিতে ফেটে পড়বে না হে,

মানুষের কান্নার চারণ কবিবর?

কিন্তু না, এ সত্য নয়।

আমি কি দেখিনি সেই অদ্ভুত

শোক-পরিহিতা মূর্তি? কী ভয়ানক!

একদিন সে এলো আমার বাড়ি।

আমার মুখ বেদনা-মানান কয়লা-কালো আর সাদাটে সীসা

যা কিনা বিষাদ-প্রহসনকেই মানায় ঠিক

‘আমি তোমাকে দেব কবির মহিমা’

সে বলল আমায়, ‘একবিন্দু অশ্রুর পরিবর্তে’

অপর দিনে সে আবার আমায় হাসতে বলল

কেবল তার শূন্য হাসিদান পূর্ণ করতে।

এমন আত্মাও আছে যারা নাটুকে সুখীপনার মুখোশ-প্যারেডেও

হয়ে ওঠে বিষণ্ণ ভাঁড়।

কিন্তু কবি, নিজের সত্যকা্র বিজন গোপন ঘরে

হয়ে ওঠো নিরেট স্ফটিক

আনন্দ ও অশ্রু

হয়ে ওঠো প্রেমের হৃদনৌকো, ফুলদান, সুগন্ধছায়া।


 

বাগান

মূল কবিতাঃ খার্দিন

 

তোমার বাগান থেকে দূরে বিকেলটা পুড়ছে

তামাটে ছাইবনের পারে

উজ্জ্বল আলোফণায় সোনালী সুগন্ধ

তোমার বাগানে ডালিয়া হয়

তোমার বাগান এক ক্ষয়।

আজ আমার মনে হয় এ যেন 

একটা চুল সাজানেওয়ালীর কাজ।

ওই বেচারা বামন পাম গাছটা

বা ওই মুড়োনো মার্তেলের ছবিটা

আর তোমার ওই অল্প কমলা পিপেটা…

পাথুরে জলের ফোয়ারা সাদা শাঁখটাকে নিয়ে

হাসি থামাতেই চায় না।


 

একটি গ্রীষ্মের রাত

মূল কবিতাঃ নোচে দে ভেরানো

 

একটি চমৎকার গ্রীষ্মের রাত

ওদের লম্বা লম্বা বাড়ি আছে

পুরনো শহর থেকে চওড়া-চৌকো রাস্তা অবদি বারান্দা ছড়ানো

সেই শূন্য একাকী আয়তাকারে

পাথরের বেঞ্চ, এভোনিমো আর আকাশিয়া গুল্ম

সমান্তরালভাবে তাদের কালো ছায়া এঁকেছে

সাদা বালুচরে।

আকাশে রয়েছে চাঁদ, উঁচু টাওয়ারগুলোয় দৃশ্যমুখ

এ শহরে একা আমিই প্রেত হয়ে একক হাঁটি।


 

স্বপ্নেরা 

মূল কবিতাঃ লস সুয়েনিওস

 

সবচেয়ে সুন্দর পরীটি, একটা বিবর্ণ তারার

আলো দেখে হেসেছে যে,

নরম, সাদা আর নিশ্চুপ কাপড়ে নিজের

সোনামাথাবোনের টাকুর চারপাশে মুড়েছে নিজেকে।

ওই সে আবার হাসল

কারণ তার চরকার সুতো হয়ে জড়িয়ে গিয়েছে জমি।

শোবার ঘরের ঢিমরঙা পর্দার ওপারে বাগান

নিজেকে মুড়েছে সোনালী আলোয়।

শিশুর বিছানা আছে প্রায়-ছায়ায়।

শিশুটি ঘুমায়।

দুটি পরিশ্রমী পরী সঙ্গ দেয় তাকে

স্বপ্ন-মাকু ঘোরে,

সূক্ষ্মগুলির গুঁড়ো ছড়ায় গজদন্তে

রূপোলি চরকা-চাকায়।।

 

শীতের সূর্য

মূল কবিতাঃ সল দে ইনভিয়ের্নো

 

এখন দুপুর। এ্কটা পার্ক।

শীতকাল। সাদা পথ।

প্রতিসম ঢিপি। কঙ্কাল শাখা।

গ্রীনহাউসের নিচে টবের কমলা গাছেরা

আর তোমার সবুজরঙা ব্যারেলে, পাম গাছটা।

একজন বুড়ো মানুষ বলছে,

তোমার পুরনো চাদরেরজন্য

“সূর্য, এই সুন্দর সূর্য…”

বাচ্চারা খেলে।

ঝরনা থেকে জল ফসকায়

ছোটো আর স্বপ্ন দেখো শুষে নেবার

এটা সবজে পাথরটাকে বদলে দেয়, প্রায়।

 

 

শৈশব স্মৃতি 

মূল কবিতাঃ রেকুয়ের্দো ইনফ্যান্টিল

 

একটা ঠাণ্ডা বাদামী শীতের বিকেল।

স্কুলের ছেলেরা পড়ে।

স্ফটিকের ওপারে বৃষ্টির একঘেয়েমি।

 

এটাই ক্লাসটা।

একটা পোস্টারে কেইনকে পলাতক বলা রয়েছে

আর অ্যাবেল মৃত, একটা রক্তরঙা দাগের পাশে।

তীব্র আর ফাঁপা ঘণ্টা সহকারে শিক্ষক গর্জান

এক অসহ-পোশাক বৃদ্ধ ঝুঁকে পড়েন এবং শুকোন,

যাঁর হাতে কিনা একখানা বই আছে।

আর একটা বাচ্চাদের কয়্যার সুরে সুরে পড়া করছেঃ

একশো হাজারে একলাখ

একহাজার হাজারে দশলাখ।

 

একটা ঠাণ্ডা বাদামী শীতের বিকেল।

স্কুলের ছেলেরা পড়ে।

কাচের ওপারে বৃষ্টির একঘেয়েমি।


 

নভেম্বর, ১৯১৩

মূল কবিতাঃ নোভিয়েমব্রে, ১৯১৩

 

আরো একটা বছর।

বপনকারী বীজ ছুঁড়ছে মাটির ফুটোয়।

দুটো দল কর্ষণে ব্যস্ত, যখন ছাইরঙা মেঘ

মাঠ কালো করে ভেসে যায়

বাদামী মাঠ, অলিভ-ধূসর

নদী উপত্যকার তলা থেকে

মেঘেলা জল বয়।

কাজোর্লার বরফ আছে, আর মাখিনার ঝড়।

তার পাহাড়, আজনাইতিন।

গ্রানাডায় পাহাড় আছে সূর্যের সাথে

সূর্যের পাহাড় আছে আর আছে পাথর।

 

 

No comments

Powered by Blogger.