ঋপণ আর্য


 

রঙে গুলে আছি যেভাবে

 

মাটি আর পশুর চর্বি মিশিয়ে মানুষ প্রথম রঙ তৈরি করেছিল। সে নাকি আজ থেকে প্রায় পনেরো হাজার বছর আগে। হয়তো তারও বেশি। কিন্তু আমি ভাবছি, পনেরো হাজার বছর আগে শিকার করে মানুষ ফিরছে গুহায়, আগুনে ঝলসে একসাথে সেই খাবার ভাগ করে নিচ্ছে। তারই অবকাশে হয়ত সেই পশুর চর্বি আর মাটি মিশিয়েই বানাচ্ছে রং। গুহার দেওয়ালে ছবি আঁকছে পৃথিবীর প্রথম শিল্পী। হয়ত, সেই মৃত পশুটির থেকে নেওয়া রং দিয়েই তাকেই শিকার করার দৃশ্য আঁকছে। অদ্ভুত! এই যে রঙ দিয়ে দৃশ্যের পরিচয় হল। আমারও রঙ দিয়ে দৃশ্য আঁকতে ইচ্ছে এল, একটা সবুজ চুড়িদার একটা নীল সার্টের সাথে সিনেমায় যাচ্ছে। একটা হলুদ পাঞ্জাবী একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ির সাথে পার্কে বসে বাদামে চুমু মাখিয়ে খাচ্ছে। ভীমদর্শন দুটো ষাঁড়ের ভেতর দিয়ে একটা লাল সার্টের অবলীলায় হেঁটে যেতে দেখে দাঁড়াই। আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পাই, সামনের বাড়ির দোতালার ব্যালকনির নীল সালোয়ার আমার মতোই চমকেছে। তার পাশের খাঁচায় সবুজ টিয়া। সবুজেরও রকম ফের আছে বলেই ওই টিয়ের রঙে পাগলার বাবার বানানো সেই বিশাল বোঁ-ঘুড়িটা মনে এল, খোকা পাগলাকে যে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল একদিন।  সুতোর সাদায় মাঞ্জা বসে ছিল বলেই টানের পাল্লায় সে হাস্যকর ভাবে দৌড়াচ্ছিল, আমরা তার পেছন পেছন। পাগলা তবু ছোট্ট সেই লাটাইটা ছাড়েনি। লাটাইটা ছোট্ট ছিল কেননা ওই লাটাই গলিয়ে ছোটো ছোটো গোল গোল রঙিন কাগজের চিঠি  হাওয়ার ধাক্কায় সুতো বেয়ে ঘুড়ির কাছে পাঠাতাম। ওই চিঠির বয়সে আমার ছেলেবেলা, বাবা বাজার থেকে মধ্যবিত্ত চকলেট নিয়ে ফিরতেন। আমার আর বোনের চকলেটগুলোর রঙের ফারাক নিয়ে সে কী যে কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়ি, চুলোচুলি! রঙিন প্রজাপতি, ফড়িংয়ের পেছনের সেইসব ‘ছুটফুটন্ত’দের নিত্যলোকে বেঁচে থাকার নানান রঙের ভেতর থেকে আলাদা করতে পারি না। বেঁচে থাকার আগে তো বেঁচে আছি তাই না? তবে ‘বেঁচে আছি’ বললে কয়েক হাজার জলরঙ-তেলরঙ ব্যবহার করা যায়। আর শুধু ‘আছি’ বললে তার আগে পিছের দৃশ্যে-অদৃশ্যে কোটি কোটি রঙ ব্যবহার করতে পারি বা রঙও আমাকে কোটি কোটি ব্যবহার করতে পারে। তাই এ রঙ সে রঙ মেশাতে মেশাতে দেখি এমন একটা রঙে দাঁড়িয়েছে যা আগে কখনও দেখিনি! পরে হাজার চেষ্টাতেও কিন্তু সেই রঙ ফেরে না! যেভাবে কোনও খিচুড়ি কিছুতেই আর ভাতের সাদায় ফেরে না।  মানুষ তবু কালো থেকে সাদায় যেতে চায়। সারা পৃথিবীর নানা স্থানের আদিবাসী গোষ্ঠীদের গায়ের রং-এর গড় করে দেখা যাচ্ছে, বিষুবরেখা থেকে যতদূরে যাওয়া যায় গায়ের রং ততই হাল্কা হয়। কারণ, বিষুব অঞ্চলে ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তাই ত্বক রক্ষাকারী মেলানিনও বেশি। কিন্তু যত এই অঞ্চল থেকে দূরে যাওয়া যাবে মেলানিন কমে গিয়ে গায়ের রং কালো থেকে সাদায় ক্রমশ। বিষুব অঞ্চল বা আফ্রিকার তৃণভূমিতে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষেরা যখন থাকতেন, তখন তাদের গায়ের চামড়ার রং ঘন কালোই ছিল। কিন্তু তারা যখন উত্তর-পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর-পূর্ব-মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল, তখন বিষুব অঞ্চল থেকে দূরে যাওয়ার কারণে এবং পুরুষদের হাল্কা রঙের প্রতি আকর্ষণের কারণে জনসংখ্যায় হাল্কা রঙের চামড়ার অনুপাত বাড়তে থাকলো।

আর প্রতিটি জনগোষ্ঠীতেই মেয়েদের গড় মেলানিনের পরিমাণ পুরুষদের তুলনায় বেশ কম। মানে, তুলনামূলক মেয়েরা বেশি ফর্সা।

রাধাও তাই ফর্সা। কিন্তু অভিমান তাকে দুধে-আলতা রঙে রাঙিয়েছে। শ্রী রাধিকার অভিমান হয়েছে তার কৃষ্ণের ওপর। তাই, সে পণ করেছে, ঐ রূপ সে আর দেখাবে না। যেহেতু কৃষ্ণ কালোবরণ, তাই কালো রঙের দিকে তাকাবে না। এ কথা শুনে সখীরা রাধাকে বলছে,--রাধে, যমুনার জল যে কালো। তুমি কী তাহলে যমুনায় জল আনতে যাবে না? রাধার উত্তর, না। সে যাবে না। সখীরা আবার বলছে, রাধে, মেঘ যে কালো। রাধা জানিয়ে দিল, সে মেঘের দিকে তাকাবে না। এবারে সখীরা বলছে, তোমার চুল যে কালো রাধিকে। রাধা বললো, সে চুল কেটে ন্যাড়া হয়ে যাবে। এক সখী বললো, রাধা, তোমার চোখের মণি যে কালো, তার তুমি কী করবে? রাধা বললো, সে নিজের চোখ উপরে ফেলবে। সখীরা বলছে, তাহলে তুমি তো কানা হয়ে যাবে। রাধা এর উত্তরে বললো, তার কানা-ই ভালো। সখীরা এবারে কুঞ্জবন মাতিয়ে হাসতে হাসতে বলতে লাগলো, তা তোমার কানাই যখন ভাল, তাহলে তার সাথে আড়ি কেন? ভাব করে নিলেই হয়।

 

শ্রীরাধার মতো রঙেরও একটা অভিমান আছে। কোথাও কোথাও সে রাধাকে ছাপিয়ে দাঁড়হীন-পালহীন থইথই মনপুরা। আমার কোনও মপপুরা নেই। কানে তাই রঙ শুনি, ঘুমের পাতলা থেকে গাঢ় হবার রঙ। অন্ধকার রঙেরও ফারাক আছে বুঝেছিলাম, যেদিন প্রথম সিনেমা হলে ঢুকে ঠোক্কর খেতে খেতে সীট পেয়েছিলাম। সে সীটে বসে খানিক বাদেই অন্ধকার পালটে গেছিল, তখন ঠোক্কর না খেয়ে উপরের সারির লাল রঙের সীটগুলো আবছা সাদা রঙে চেনা যাচ্ছিল। আমরা আসলে সব টিকে থাকা রঙেদের এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি না। আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, অভ্যাসের রঙেরা এদিক-সেদিক হলেই। আমার পরিবারের; ধরাযাক মা, তার সাথে দৈনন্দিন সম্পর্কে তো জড়িয়ে আছি। আমার মা আমাকে দেখছে, আর আমিও মা'কে দেখছি। তবে যা দেখার অভ্যাস তার বাইরে কিছু দেখছি না। যদি তার বা আমার চোখ হঠাৎ লাল হয়ে ওঠে; অসুস্থতার লক্ষণ লক্ষ্য করে কারণ জানতে চাইব। এখন কথা হচ্ছে, চোখের এই জরুরি রঙ কে বসালো? চোখের এই জরুরি রঙের প্যালেট হল এই দেহ, তুলিও। মোটকথা দেহই শিল্পী। তাই তো সে আমার গোলাপি জিভ থেকে সাদা দাঁতকে আলাদা করে রেখেছে। চোখের পাতার সাথে পায়ের পাতার কোনও মিল রাখেনি! এমন কত কত অমিলের ভেতর মিলের প্রসঙ্গ নিয়ে জগতে কত কত গন্ধের টিকে থাকা জেগে আছে ইয়াত্ত্বা নেই।

 

রঙের একটা গন্ধ আছে। অতীতের ফেলে আসা রঙ কখনো সখনো নিদারুন খুশবু হয়ে ওঠে। তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে আমাদের রুদ্রপুরের পাশেই বেলেরমাঠে দু’জন ক্লাস টু-এর গৃহশিক্ষক হই । যাতায়াতের পথে একটি মেয়েকে রোজ দেখতাম। কেন জানি না তাকে দেখলেই বাকি দিনটুকু আলোয় আলোয়। ওদের পাড়ার এমনকি অসম্পাদিত ঝোপঝাড়কেও খুউব ভাল লাগত। সেবার হোলির আগের দিন রাতে একটা জোরদার ইচ্ছে এল, তার সাথে যে করেই হোক আমি-ই প্রথম রঙ খেলব। সেই হিসাবে যুক্তিতে একটা পারফিউম তৈরি করে সেদিনই রাত দুটোয় আবীর সহ পৌঁছে ছিলাম তার বাড়ি। তাদের ঘরের দাওয়ার সামনে লেপে দিয়েছিলাম কেজি খানেক আবীর। আমি নিশ্চিত, অতি সকালে রঙ খেলা শুরু হবে না, ঘুম ভেঙে সে দেখবে তার উঠোন। মজাটা এখানেই, চোখ হল পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের একটা, যা দিয়ে সে স্পর্শ করবে আমার হাতের রেখে আসা রঙ । কতদিন হয়ে গেল আহা সেই পারফিউমের গন্ধে এখনও অন্ধকাররা আনন্দে কেটে যায়।

 

'অন্ধকারে যায় না দেখা কিছুই

অন্ধকারে তোমায় দেখা যায়।'

 

আর দেখা যায় বলেই অন্ধকারে বা গাঢ় ঘুমের স্বপ্নে পতাকার রঙ বলে দেব, বাঘের গায়ের রঙ বলে দেব, কচিকলাপাতার রঙ বলে দেব, ভ্যানগঘের প্রিয় হলুদ বলে দেব।

 

আচমকা আমার পাশে থাকা বন্ধুটা বলে উঠলো,

—কী রে আমার কথা শুনছিস না নাকি?

 

না, সত্যিই শুনিনি। অথচ কানে কোনও আঙুল গোঁজা ছিল না! আমি যে রঙে মরেগেছি তা তো বোঝানো উচিত নয়। তাই দ্রুত বন্ধুর রঙে ফিরে আসি। আর জানতে চাই, তার প্রিয় রঙ। সে অমনি তার প্রিয়জনের নাম বলে ওঠে।  সে আমার প্রিয় রঙ জানতে চাইলে তাকে কমলার কথা বলি। আমি আমার পৃথিবীটাকে কমলা দিয়ে বোঝাই। তারপর বন্ধুটিকে সেই কমলা থেকে একটা একটা করে কোয়া খুলে দিই।

 

কবিতা এমনই

 

 

বি:দ্রঃ গদ্যটি বেশ পুরনো। গদ্যটিকে সমৃদ্ধ করেছিল কবি ও উপন্যাসিক অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়। এসেছে গায়ক গীতিকার দেবদীপ মুখোপাধ্যায়ের দুই পঙক্তিও। সব মিলিয়ে বলা যায় একটি যৌথ লেখা, আমি কেবল নিজ ভাবনার সাথে তাদের জুড়ে জুড়ে সম্পাদনা করেগেছি মাত্র।

No comments

Powered by Blogger.