বিলি কলিন্সের সাক্ষাৎকারঃ অংকুর সাহা


উইলিয়াম জেমস কলিনসের (সংক্ষেপে বিলি) জন্ম মার্চ ২২, ১৯৪১, ন্যু ইয়র্ক শহরে। সেখানকার কলেজ অফ দ্য হোলি ক্রস থেকে ইংরেজিতে বি.এ. ডিগ্রি সমাপ্ত করে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় আসেন এবং রিভারসাইড শহরের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ এবং ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সাল থেকে ন্যু ইয়র্কের লেহম্যান কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপনা। ১৯৭৫ সালে বন্ধু মাইকেল শ্যাননের সঙ্গে যৌথভাবে“ মিড অ্যাটলান্টিক রিভিউ” নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সূচনা করেন। কাগজটি চলেছিল পনেরো বছর।
১৯৭৭ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ “নির্বিকার মুখ”; তারপরে আরও বারোটি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য - “যে আপেল স্তম্ভিত করেছিল প্যারিস শহর” (১৯৮৮), “দেবদূতের বিষয়ে প্রশ্ন” (১৯৯১), “ডুবে যাওয়ার কায়দা” (১৯৯৫), “এমিলি ডিকিনসনকে ন্যাংটা করে” (২০০০), “কবিতা নিয়ে সমস্যা”(২০০৫), “মেয়েটির বয়েস সতেরো”(২০০৬), এবং “মৃত মানুষদের ঠিকুজি” (২০১১)।
কলিন্সের কবিতার বই বিক্রি হয় হাজার হাজার কপি। এক একটি কাব্যগ্রন্থের জন্যে অগ্রিম এবং রয়্যালটি মিলিয়ে তাঁর আয় হয় কয়েক লক্ষ ডলার। তার ওপরে রয়েছে কবিতা আবৃত্তির কমপ্যাক্ট ডিস্ক।তিনি খুব সম্ভবতঃ আমেরিকার জনপ্রিয়তম কবি। তিনি মার্কিন কবিতায় নতুন দিগন্ত এনেছেন তাতে হাস্যরসের সূচনা করে। তাঁর কবিতা পড়লে তারাপদ রায়ের কথা বিশেষ ভাবে মনে পড়ে।
বিলি কলিনসের জীবন ও সাহিত্য বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য আমি সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর দুটি সাক্ষাৎকার থেকে কিছু নির্বাচিত প্রশ্ন ও উত্তরের বাংলা অনুবাদ করছি। একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জর্জ প্লিম্পটন “প্যারিস রিভিউ” সাহিত্যপত্রের জন্যে, অন্যটি গ্যের্নিকা কাগজে প্রকাশিত জোয়েল হুইটনির নেওয়া সাক্ষাৎকার। প্রথম প্রশ্নের উত্তরটি পড়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে - কলিন্স কি ইংরেজি অনুবাদে “কমলাকান্তের দপ্তর” পড়েছেন?  

প্রশ্ন : আপনি কীভাবে কবিতা লেখেন?

উত্তর : আমি লিখি অনিক্স মাইক্রোপয়েন্ট কলম দিয়ে, ন’ইঞ্চি লম্বা আর সাত ইঞ্চি লম্বা চওড়া বাঁধানো নোটবুকে; কানাডার ‘ব্লুলাইন’ নামে একটি কোম্পানি এই নোটবুকগুলো বানায়।পরপর কয়েকটি খসড়ার শেষে সম্পূর্ণ হয় কবিতাটি; তখন ম্যাকিন্টশ কমপিউটারে টাইপ করে কবিতাটি বাইরে কাউকে পাঠাই।

প্রশ্ন : এ সবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, কিন্তু যে কবিতাটি সৃষ্টি করে আপনি পাঠালেন, তার ভেতরের কথা কিছু বলবেন? একটি কবিতার উৎসমুখ এবং গঠনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বলবেন কি?

উত্তর : প্রথমে অনেক অনেক অপেক্ষা করে থাকা, তারপরে হয়তো একটা কিছু ঘটে। আমার সতীর্থ কবি ন্যু ইয়র্কের ডেভিড লেম্যান (১৯৪৮ - ) অথবা অরিগনের উইলিয়াম স্ট্যাফোর্ড (১৯১৪ -১৯৯৩) তুমুল প্রচেষ্টা চালিয়েছেন প্রতিদিন অন্তত একটা করে কবিতা লেখার জন্যে। বহুকাল আগে রোম সামাজ্যের কবি কাতুল্লুস (আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৮৪-৫৪) বলেছিলেন “এক লাইন না লিখে একটা দিনও নয়” - এঁরা তাঁর থেকেও এক কাঠি ওপরে। কিন্তু বেশির ভাগ কবি রোজ একটা করে কবিতা লেখেন না। তাঁদের কাছে কবিতা লেখার পদ্ধতির অনেকটা জুড়ে রয়েছে অপেক্ষা - কিন্তু তার মধ্যে সদাজাগ্রত থাকা কবিতার আবির্ভাবের জন্যে। আমার মনে হয় একটা ভালো পঙক্তি দিয়ে কবিতা রচনার সূত্রপাত; কিন্তু কখনও আবার তারপরে কিছু নেই - শূন্যতা, ধুধু, খাঁ খাঁ পোড়ো জমি; কিন্তু কখনও আবার প্রথম পঙক্তিটাই চাইবে আপন মনে সামনে এগিয়ে যেতে। তখন কবি তাঁর ভেতর থেকে অনুভব করবেন এক ধারাবাহিক চালিকাশক্তি  কবিতা নিজেই তার প্রেরণা খুঁজে নেবে এগিয়ে চলার। প্রথম পঙক্তিটাকে বলতে পারেন উঘঅ ; তার মধ্যেই রয়েছে বাকি কবিতাটার জীবন সংকেত। প্রথম তীব্রতা, উজ্জ্বলতা অথবা মেজাজকে খেয়াল রাখা সবচেয়ে জরুরি, কারণ পুরো কবিতাটাই নির্ভর করে তার ওপর। প্রথম পঙক্তি থেকে কবি ও পাঠকের মধ্যে গড়ে ওঠে বিশ্বাসের বন্ধন । অতীতে সেই বন্ধনটা ছিল ছন্দ, যতি ও অন্তমিলের; এখন তার স্থান নিয়েছে কবিতার মেজাজ। প্রথম কয়েকটি পঙক্তির গর্ভেই জন্ম নেয় বাকি কবিতার শরীর। সূচনার সময় আমি জানি না কোথায় চলেছি। কলম কেবলমাত্র আমার মনের ভাবনা লিখে রাখার যন্ত্র নয়, কলম হ’ল নতুন নতুন আবিষ্কারের দিগদর্শক কম্পাস। কলম দিয়ে আপনি যখন লেখেন চাকরির পদত্যাগপত্র অথবা সভার কর্মসূচী, তখন তার এক রকম ব্যবহার। কবিতা লেখার সময় কলম হয়ে দাঁড়ায় পথ দেখানো মশাল, পারমাণবিক বিকীরণ মাপবার গাইগার গণকযন্ত্র অথবা মূল্যবান ধাতুসন্ধানীর মেটাল ডিটেক্টার। আপনি এমন কিছু সামগ্রী আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই, কিন্তু মনের মধ্যে জানেন যে সামগ্রীটি মূল্যবান।

প্রশ্ন : প্রথম পঙক্তিটি কিসের অনুপ্রেরণায় আসে? চোখের সামনে দেখা কোনো কিছু? স্বল্পস্থায়ী কোনো ভাবনা? অথবা অন্য কবির কবিতার কোনো লাইন?

উত্তর : দূরের কোনো প্রভাব থাকা সম্ভব নিশ্চয়ই, কিন্তু আমার মনে হয় যে পঙক্তিটি নির্গত হয় নিজের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে। যে সব তুচ্ছ এবং গুরুত্বহীন শব্দ ও ভাবনা ভেসে চলে মাথার মধ্যে তাদের দিকে তীক্ষ নজর রাখলে কোনো একসময় তার থেকে হঠাৎ লাফিয়ে উঠতে পারে মূল্যবান কিছু। এছাড়া আমি চেষ্টা করি যাতে কবিতার শুরুটা হয় দৈনন্দিন সাধারন কথাবার্তার মতন। কবিতা আমার কাছে এক সামাজিক অঙ্গীকার। কবিতার মাধ্যমে আমি হতে চাই মিশুকে, সঙ্গপ্রিয় এবং অতিথিপরায়ণ; কবিতার নাম এবং প্রথম পঙক্তি আসলে পাঠককে কবিতার ভিতরে প্রবেশ করতে সাদর আহ্বান জানানো। কবিতার গভীরে গিয়ে পাঠকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হতে পারে জটিলতর, কিন্তু তার সূত্রপাতকালে আমি হতে চাই মনোমুগ্ধকর, প্রলোভনময়।

প্রশ্ন : আর লেখার পরে তার পরিমার্জনা?

উত্তর : আমি লিখি খুব দ্রুত। পরিমার্জনা করিই না বলতে গেলে। একবার বসেই পুরো কবিতাটা নেমে যায় কাগজে। কুড়ি থেকে চল্লিশ মিনিটে খেল খতম। তার পরে হয়তো ফিরে যাই দুয়েকটা শব্দ বদল করতে, আবার কয়েক হপ্তা পরে ছন্দ অথবা ধ্বনি সংক্রান্ত কারণে একটা লাইন একটু পাল্টে দিই, কিন্তু বেশিরভাগ সময় পুরো কাজটা সম্পন্ন হয় একলপ্তে। কবিতার মধ্যে থাকে এক অলংকারময় গতি। সেটা প্রথম বারেই না এলে সব চেষ্টাই বৃথা। তখন সেটাকে ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

প্রশ্ন : একেবারেই জঞ্জাল মনে করে ফেলে দেন?

উত্তর : অনেকে বলেন, কোনো লেখাই ফেলে দেওয়া উচিত নয়। কবিদের কর্মশালায় একই উপদেশ প্রায়ই দেওয়া হয় -“যা কিছু লিখবে পছন্দ না হ’লেও তুলে রাখবে। পরে অন্য কোনো কবিতায় ব্যবহার করতে পারবে। ” আমি তাতে বিশ্বাস করি না। আমি সদ্য লেখা কবিতা, ভালো না লাগলে ফেলে দিই। পরবর্তী কোনো কবিতার গায়ে তাকে স্কচ-টেপ দিয়ে আটকে দেবার কোনো মানেই হয় না। সেটা সুসমন্বিত হবে না, অরগানিক হবে না, কবিতার যে মেরুদণ্ড, “চি”, যেটা তার সামগ্রিক সঙ্গতি সেটাই হবে অনুপস্থিত।

প্রশ্ন : এই যে নতুন শব্দটা ব্যবহার করলেন, সেটা কী?

উত্তর : চি”- ফংশুই এর মধ্যে শব্দটির ব্যবহার চলে । এক ধরণের শক্তি, যেটা প্রবাহিত হয় পার্থিব বস্তুর মধ্যে। যে কবিতার তার অভাব থাকবে সে প্রাণহীন । মনে হবে যান্ত্রিকভাবে কিছু শব্দকে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে । কবিতার ওয়ার্কশপ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সাহিত্যের এম. এ. (মাষ্টার অফ ফাইন আর্টস) পাঠক্রমে কেবলই শেখানো হয় কবিতার সংস্কার । কিন্তু ক্রমাগত সংস্কার মানে কবিতার আনুষঙ্গিকসুদ্ধ আবেগকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া । অবশ্য লেখা আর সংস্কারের মধ্যে সীমানাটুকুই অবাধ এবং অনিয়ন্ত্রিত -আমি যখন লিখছি তখন পরিমার্জনাও করছি, আবার যখন পরিমার্জনা করছি তখন লিখছিও।

প্রশ্ন : আপনার ছেলেবেলার কথা বলুন, মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ?

উত্তর : আমার মা বাবা দুজনেরই জন্ম ১৯০৯ সালে -দুজনেই নব্বই বছরের বেশি বেঁচে ছিলেন , অর্থাং বিংশ শতাব্দীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অব্দি । বাবার জন্ম এক আইরিশ পরিবারে, ম্যাসাচুসেট্ রাজ্যের লোয়েল শহরে যেখানে কবি জ্যাক কেরুয়াকের (১৯২২-১৯৬৯) জন্মস্থান । আমি সেখানে কোনোদিন যাইনি ,তবে সম্প্রতি ওই শহরের একটি সাহিত্য পত্রিকা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে যেতে । একই শহরে জন্ম হলেও আমার বাবার সঙ্গে কেরুয়াকের সামান্যতমও মিল নেই । বাবা নিল ক্যাসিডির গাড়িতে চড়লেই ভয়ে ভয়ে বলতেন -সামনের মোড়ে নামিয়ে দাও আমায় । মায়ের জন্ম কানাডার এক খামার বাড়িতে। আমি পড়তে শেখার আগেই মা আমাকে নিয়মিত বই পড়ে শোনাতেন । আমার শৈশবের সে এক মধুর অভিজ্ঞতা। পড়তে শেখার আগেই অবশ্য আমি ভান করতাম বই পড়ার - বাড়িতে লোক এলেই আমি ইজিচেয়ারে বসে, কোলে একটা মোটা বই নিয়ে গম্ভীর মুখে পাতা ওলটাতাম । বলতে পারেন ছোটবেলা থেকেই আমি দুনম্বরি ।

প্রশ্ন: কবিতা লেখা শুরু করলেন কখন ?

উত্তর : খুব অল্প বয়সে আমার লেখা শুরু । এখনও মনে আছে কবে লেখার অনুপ্রেরণা পাই। তখন আমার বয়স দশ -ন্যু ইয়র্র্কের এফ.ডি. আর ড্রাইভ ধরে গাড়ি করে যাচ্ছি -সামনের সিটে মা-বাবা, পিছনে আমি । এমন সময় ইস্ট রিভারে একটা পালতোলা নৌকা দেখে আমি মায়ের কাছে কাগজ-পেনসিল নিয়ে গাড়ির মধ্যেই লিখতে শুরু করি । মনে নেই ঠিক কী লিখেছিলাম, কিন্তু সেই প্রথম একটা দৃশ্য চোখের সামনে দেখে আমার মনে হয়েছিল -এটা লিখে রাখা দরকার । সাহিত্যের জগতে আমার সেটা প্রথম পদক্ষেপ! তবে আমার কবিতার প্রথম বই বেরোয় অনেক পরে - আমার বয়স তখন চ্িল্লশের কাছাকাছি ।কবি হিসাবে আমার বিকাশ ঘটেছে দেরিতে। আমি নির্জনেই থাকতাম, কবি সভাতে যেতাম না বা অন্য কবিদের সঙ্গে মিলতামও না ।

প্রশ্ন : ‘রেলিং স্টোন” পত্রিকায় বেরিয়েছিল আপনার কবিতা?

উত্তর : হ্যাঁ , রোলিং স্টোন কাগজের পিছনের পৃষ্ঠাগুলিতে আমার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু। চার কিংবা ছয় লাইনের ছোট কবিতা-রেকর্ড নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে। সেগুলো বেশির ভাগই ভালো কবিতা নয়, বোকা বোকা কবিতা। রোলিং স্টোন সাহিত্য পত্রিকা নয় , কিন্তু তার পাঠকসংখ্যা প্রচুর; কবিতা পিছু আমি পঁচিশ ডলার করে পেতাম । সেটা হ’ল ১৯৭০ দশকের কথা -আমি তখন ছোট সাইজের কবিতা লিখতাম । আমি ভাবতাম কবিতা হ’ল জন্মদিনের মোমবাতির মতন -এক ফুঁয়েই তাকে নিভিয়ে ফেলা যায়। বড় কবিতা কীভাবে লেখা যায় , আমার লিখতে অনেক সময় লেগেছে । আস্তে আস্তে আমি কবিতাকে তার সীমানার বাইরে প্রসারিত করতে শুরু করি- এটা অনেকটা কবিতাকে কিছু বাড়তি জীবনীশক্তি দেবার মতন ঘটনা। প্রথম দিকে আমি আমাকে, অর্থাৎ নিজেকে রাখতাম আমার কবিতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে; কিন্তু কীভাবে জানি না। আমি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার কবিতার অন্দর মহলে প্রবেশ করি ।যে কবিতার কাগজটি আমায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে ,তা হল শিকাগোর পোয়েট্রি পত্রিকা । বাবার ওয়াল স্ট্রিটের আপিসে নিয়মিত আসত পত্রিকাটি -আমি জানি না কীভাবে তার আগমন; আপিসে কেউ তার পাতা উল্টিয়ে ও দেখতেন না। আপিসের বড়কর্তা ছিলেন পরোপকারী , দানশীল মানুষ-তিনি হয়তো কিছু অনুদান দিয়েছিলেন পত্রিকার দপ্তরে, যার ফলে কাগজটি নিয়মিত আসত ।বাবা জানতেন কবিতায় আমার অনুরাগের কথা এবং প্রতি মাসে তিনি বাড়িতে নিয়ে আসতেন পোয়েট্রি পত্রিকার সংখ্যা । সেখানেই সমসাময়িক কবিতার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় । তার আগে পর্যন্ত আমার দৌড় ছিল পাঠ্যপুস্তকের কবিতা - হেনরি ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ লংফেলো (১৮০৭-১৮৮২) অথবা জন গ্রিনলিফ হুইটিয়র (১৮০৭-১৮৯২) | এখানে পোয়েট্রির পাতায় শুনতে পেলাম আধুনিক কবিদের কথোপকথন । তাদের ভঙ্গিটি স্বচ্ছন্দ ও নিরুপদ্রব এবং আমার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায় । আঠারো বছর বয়সে আমি ডাকে কয়েকটি কবিতা পাঠাই পোয়েট্রির দপ্তরে । উত্তর লেখেন হেনরি রেগো (১৯১৩-১৯৬৯) স্বয়ং এবং উৎসাহ দেন নিয়মিত লিখতে (কিন্তু বলেন নি যে আরও কবিতা পাঠাও ) । আমি তখন পুরোপুরি অন্ধকারে -ভেবেছিলাম,সকলেই এরকম চিঠি পায়। হয়তো পায়ও । কিন্তু পোয়েট্রিতে আবার লেখা পাঠিয়েছি পঁচিশ বছরেরও পরে । ১৯৮৭ সালে জোসেফ পেরিসি * (১৯৪৪-) আমার কয়েকটি কবিতা সেখানে প্রকাশ করলেন -তারপর থেকে এই পত্রিকায় আমার প্রকাশ নিয়মিত। প্রথমবার এবং দ্বিতীয়বারের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান । খুব সম্ভবত তরুণ কবিদের উচিত কোনো কাগজে প্রথমবার কোন কবিতা পাঠিয়ে ব্যর্থ হলে, দ্বিতীয়বার পাঠানোর আগে একটা সম্মানজনক সময় অপেক্ষা করা, সেটা পত্রিকাটির পক্ষেও সন্তোষের কারণ হবে ।

প্রশ্ন: কিন্তু এই পঁচিশ বছর ধরে আপনি কী করলেন ?

উত্তর : আমি লিখে চলেছিলাম -নানা কবির প্রভাব ছিল আমার লেখায় । বেশ বাজে লিখছিলামও। সত্যি কথা বলতে কী, অন্য কবির প্রভাব যদি আপনাকে সাহায্য করে নিয়মিত লেখা চালিয়ে যেতে, সেটা একবারেই খারাপ জিনিস না। হর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬) বলেছিলেন, “আমার তখন বয়েস কম ছিল, তাই প্রয়োজন ছিল ছদ্মবেশ নেওয়া।” আমার ছদ্মবেশ প্রথমে লরেন্স ফার্লিংগেটি (১৯১৯-), তারপরে বেশ অনেকদিন ওয়ালেস স্টিভেন্স (১৮৭৯-১৯৫৫) এবং হার্ট ক্রেন (১৮৯৯-১৯৩২) | ইতিমধ্যে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি, ডক্টরেট করেছি, লেগেছি অধ্যাপনার কাজে। কবির আগমন দেরিতে এবং ধীর পায়ে । আমার মধ্যে একটা ভুল মর্ডানিস্ট বিশ্বাস ছিল তখন যে ভাল কবিতা মানে দুরূহ কবিতা Ñতাই সে সময় আমি এমন কবিতা লিখেছি পাঠকদের পক্ষে যাকে ভেদ করা অসম্ভব।

প্রশ্ন: আপনার অধ্যপনার কাজের কী কোনো প্রভাব রয়েছে কবিতার ওপরে ?

উত্তর : যেসব কবি লেখকরা অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত, তাঁদের অনেকেই বলেন যে গতানুগতিক অধ্যাপনায় ক্ষতি হয় সৃষ্টিশীল সাহিত্যের; আমার ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। আমি তিন দশকেরও বেশি ধরে সিটি ইউনিভারসিটি অফ ন্যু ইয়র্কের কলেজগুলোতে ইংরেজি সাহিত্য পড়েছি। আমি নর্টন অ্যান্থলেজির কবিতাগুলো নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের পড়াই এবং তার রেশ থেকে যায় আমার কবিতায়। তাতে কোনো অসুবিধেই নেই । বনের মধ্যে কাঠ কাটা নিয়ে আমার একটা কবিতা রয়েছে, যার প্রথম শব্দটাই হল ফ্রস্ট। রবার্ট ফ্রস্টকে (১৮৭৪-১৯৬৩) বাদ দিয়ে যদি কাঠ কাটাই অসম্ভব, সেটা তবে প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল। “ ফ্রষ্ট এই পথে গিয়েছিলেন কয়েক দশক আগে।” আমি ডবলু.এইচ. অডেন (১৯০৭-১৯৭৩) এর একটি কবিতার পুনর্লিখন করেছি। আমার “সোমবার সকাল” কবিতাটি স্টিভেন্স এর “রোববার সকাল” কবিতা অবলম্বনে লেখা। অধ্যাপনার খাতিরে এই কবিতাগুলি বার বার মন দিয়ে পড়ে আমার সুবিধেই হয়েছে।

প্রশ্ন : আপনাকে যদি একতাল মাটি দিয়ে বলা হয়, মনের মত কবি বানিয়ে নিন - কী কী গুণাবলি দেবেন তাকে?

উত্তর : হ্যাঁ, ফ্রাকেনস্টাইনের দৈত্য! প্রথমেই তাকে দেব অন্তহীন মনঃসংযোগ; তার পরে দেব ভাষা ও শব্দের প্রতি অনুরাগ। একজন মানুষ যদি অভিধান খুলে একটা শব্দ দেখতে গিয়ে যদি তাকিয়ে থাকেন সেই শব্দের দিকে এবং মিনিট কুড়ি ধরে ঘুরে বেড়ান সেই শব্দের আশেপাশে- তিনি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কবি। তাঁকে ভালোবাসতে হবে ভাষার বুনোট এবং নিয়মিত চিন্তাভাবনা করতে হবে সেই নিয়ে। আরও একটা জিনিস রয়েছে কবির দৃষ্টিভঙ্গি। এই পৃথিবীতে আমরা যে সুস্থ শরীরে বেঁচে রয়েছি- এটা একটা অলৌকিক ব্যাপার এবং তার জন্যে অসীম কৃতজ্ঞতা !

প্রশ্ন : আর অন্য কিছু নয়?

উত্তর : আর হ্যাঁ, অবশ্যই আলস্য। ভালো মানের কবিতা লেখা, দিনের মধ্যে সম্ভব, ধরুণ আধ ঘণ্টা। বাকি সময়টা কী করবেন? ম্যাক্স বিয়ারবম * (১৮৭২ - ১৯৫৬) লিখেছেন, “ কবির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হ’ল দিনের বাকি সাড়ে তেইশ ঘণ্টা কী করবেন?

প্রশ্ন : তাহ’লে আপনি কী করে কাটান দিনের সাড়ে তেইশ ঘণ্টা?

উত্তর : না, না, আমার কোনো সমস্যা নেই এ ব্যাপারে। আমি সময় পেলেই পিয়ানো বাজাই আর হাঁটতে বেরোই ‘জিনিন’ (“কলি” প্রজাতির কুকুর) কে নিয়ে - নিজের সঙ্গে আমার সময় খুব ভালো কেটে যায়। এখানেই কবিদের সুবিধে; ঔপন্যাসিকদের সকালে উঠেই টাইপরাইটারে খটাখট চালিয়ে যেতে হয়, কবিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখতে পারেন জানলার শার্সিতে মাছিদের চলাফেরা।

প্রশ্ন : আপনি উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছেন কখনও?

উত্তর : না, আমার মধ্যে কোনো উপন্যাস নেই বোধহয়। একটা উপন্যাস পড়তে আমার তিন দিন থেকে তিন হপ্তা লাগে; সেই সময়টা উপন্যাসের লেখক যেন আমার সঙ্গে থাকেন , তিনি সম্মানীয় অতিথি, আমার বাড়িতে। অন্যদিকে কবিতা এসে দরজায় কড়া নাড়ে, পাঠক দরজা খোলেন- সামনে কবি দাঁড়িয়ে। তিনি জীবন অথবা মৃত্যু নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, তারপর বিদায় নিয়ে চলে যান। পাঠক দরজা বন্ধ করে ভাবেন- এই মুখোশ পরা মানুষটা কে? কবিতা, অল্প সময়ের হঠাৎ দেখা। উপন্যাস লেখা মানে আমাকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়ে ছ’মাস কিংবা একবছর গিয়ে বাস করতে হবে চরিত্রগুলোর সঙ্গে। উপন্যাসে লেখক অন্যদের কথা লেখেন, কবিতা কবির নিজের সঙ্গে কথোপকথন। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বৃত্ত। কবিদের লেখা সফল উপন্যাসের সংখ্যা কম।

প্রশ্ন : অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

 মার্চ ২০১৩


No comments

Powered by Blogger.