রবীন্দ্র বিষয়ক আলোচনা এক অবাধ ও অনন্ত বিচরণক্ষেত্রে আমাদের পায়চারি
















সৌতিক সেন

মসজিদ মোড়ে আমাদের আড্ডায় প্রায়শই জমে ওঠে আলোচনা। চূড়ান্ত তর্কবিতর্কও চলে। আর দশটা বাকসর্বস্ব বাঙালি ঠেকে যা হয় তার থেকে ব্যতিক্রমী কিছু নয়। তবে কিনা আলোচনা, প্রতিআলোচনা তর্ক প্রতিতর্কের ভিতর বন্ধুদের নিজস্ব বক্তব্য বেশ জোরালোমাত্রায় উপস্থাপিত হয়। আমি প্রায়শই বলতাম এইসব আলোচনাগুলোর যদি অনুলিখন করা যেত ... আমাদের কথাগুলো অন্তত এভাবে হাওয়ায় হাওয়ায় হারিয়ে যেত না। স্বভাবত প্রগলভ সেই প্রস্তাব বাস্তবের আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছে আমার স্বভাবগুনে। কবিগুরুকে প্রণাম। আমার স্থবির চরিত্র গতিজাড্য লাভ করল। ইরিগেশন কলোনির নিভৃতে শিরীষ গাছের ছায়ায় দোতারা আর লাল চা সহযোগে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমাদের এই হড়হ-ধপধফবসরপ আলোচনার অনুলিখন সম্ভবপর হল। এই আলোচনার সম্পাদনা করলাম আমি, সৌতিক সেন।

সঞ্চালক-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সত্তরতম জন্মদিনে রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি প্রশস্তিপত্র রচনা করেছিলেন এবং সেটি পাঠ করেছিলেন কবি কামিনী রায়। সেই প্রশস্তিপত্রটা অনেকটা এরকম 

“কবিগুরু,
তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই। তোমার সপ্ততিতম বর্ষশেষে একান্তমনে প্রার্থনা করি জীবনবিধাতা তোমাকে শতায়ু দান করুন; আজিকার এই জয়ন্তী উৎসবের স্মৃতি জাতির জীবনে অক্ষয় হউক।
বাণীর দেউল আজি গগন স্পর্শ করিয়াছে। বঙ্গের কত কবি, কত শিল্পী, কত না সেবক ইহার নির্মাণকল্পে দ্রব্যসম্ভার বহন করিয়া আনিয়াছেন; তাঁহাদের স্বপ্ন ও সাধনার ধন, তাঁহাদের তপস্যা তোমার মধ্যে আজি সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। তোমার পূর্ববর্তী সকল সাহিত্যাচার্যগণকে তোমার অভিনন্দনের মাঝে অভিনন্দিত করি।
আত্মার নিগূঢ় রস ও শোভা, কল্যাণ ও ঐশ্বর্য তোমার সাহিত্যে পূর্ণ বিকশিত হইয়া বিশ্বকে মুগ্ধ করিয়াছে। তোমার সৃষ্টির সেই বিচিত্র ও অপরূপ আলোকে স্বকীয়-চিত্তের গভীর ও সত্য পরিচয়ে কৃত-কৃতার্থ হইয়াছি।
হাত পাতিয়া জগতের কাছে আমরা নিয়াছি অনেক কিন্তু তোমার হাত দিয়া দিয়াছিও অনেক।
হে সার্ব্বভৌম কবি, এই শুভ দিনে তোমাকে শান্তমনে নমস্কার করি। তোমার মধ্যে সুন্দরের পরম প্রকাশকে আজি বারংবার নতশিরে নমস্কার করি।” (১১ই পৌষ ১৩৩৮)
রবীন্দ্রনাথের প্রতি বাঙালির এই আবেগ স্বতঃস্ফূর্ত নাকি এটা একটা বিশেষ দিনে আবেগের বহিঃপ্রকাশ, এই মুগ্ধতার আবেশেই কি কবির বিষ্মরণ? 

কুন্তল -আমাদের অনেকের মনে ও হৃদয়ে বিরাজমান রবীন্দ্রনাথ। আমরা যারা এখনও রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, নাটকে, উপন্যাসে আশ্রয় পাই, তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃতির অভিভাবক। তাদের কাছেই এই আবেগের স্বতঃস্ফূর্ততা রয়েছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ গবেষণার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিনোদন ও ব্যবসায়িক অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে অনেকের। আমার মনে হয় বর্তমান সময়ে রবীন্দ্র-আলোচনা মানেই বেশ গুরুগম্ভীর একটা ব্যাপার। সেই আলোচনায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ, গবেষক ও অধ্যাপকদের উপস্থিতি অপরিহার্য  তাদের বক্তব্যই যেন আমাদের রবীন্দ্রভাবনার অন্তিম মানদণ্ড। এর বাইরে এই যে গাছের ছায়ায় বসে আমরা যারা এই আলোচনায় মগ্ন রয়েছি তাদের কোনো গুরুত্ব নেই। গোটা ব্যাপারটাই যেন নেহাতই তুচ্ছ, মুল্যহীন। আমার প্রশ্ন, এটা কেন হবে? রবীন্দ্রনাথ সেমিনার-অধ্যুষিত থাকবেন কেন? এই প্রশ্নটা যেমন রয়েছে  ,সেইসঙ্গে একটা পরিপ্রশ্নও থেকে যায়। কিছুটা স্ববিরোধিতা গোছের শোনালেও সেটা সত্য। সুতরাং অনস্বীকার্য। সেটা এই যে , অপ্রথাগতভাবে হলেও আমরা  রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো মৌলিক কাজ করিনি।

উত্তম - কুন্তল, এই যে বিষয়টা নিয়ে তুই যেটা বললি, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আমরা যারা অতি সাধারণ, গবেষণা বা সেমিনার থেকে কয়েক মাইল দূরে বসবাস করি তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছাবেন কীভাবে? রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন অনেক বেশি করে গ্রামে যাওয়া প্রয়োজন। গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হওয়া, একাত্ম হওয়া জরুরি। আমি খুব বেশি কবিতা পড়ি নি। যেটুকু পড়েছি, সবটুকু যে বুঝেছি এমনটাও নয়, কিন্তু বারবার পড়তে পড়তে অজান্তেই কবিতাটার সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, মনে হয়েছে যেন কত চেনা কত আপন এই কবিতার শব্দগুলো। কবিতাটা আমার প্রতিবেশি হয়ে উঠেছে। এমন এক প্রতিবেশি যার সঙ্গে আমার দীর্ঘ সহাবস্থান। যেমন ধর শঙ্খ ঘোষের এই কবিতাটি  

খালের ধারে / বনবাদারে / লতার পাতার / অন্ধকারে / দাঁড়িয়ে আছে / ঠাকুরদাদার মঠ / সেই মঠে তার শূণ্য কোলে / একটি প্রদীপ জ্বালাব বলে/ খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না তার পথ / কত গোপন দুঃখ রটায় / সুপুরি আর ঝুমকো লতায় / কত বছর কত না মাস দিন / সেসব তুমি ভুলেই ছিলে / টের পাওনি এই নিখিলে / সময় কেমন হয়েছে উড্ডীন। / আজ কি তোমার পায়ের কাছে / অন্য সোনার মাটি আছে/অন্য আলো আছে তোমার চোখে । / আজ তোমাকে টান দিয়ে নেয় /এই শহরের ন্যায় অন্যায় / ঘিরেছে কেবল নতুন নতুন লোকে / এসব যদি জানই মেকি / এসো আবার স্বপ্ন দেখি / উড়িয়ে দি সমস্ত সংকট। /বাইরে যতই কুজ্ঝটিকা / দুই চোখে হোক দিব্য শিখা / বুকের মধ্যে ঠাকুরদাদার মঠ।

ঠিক এইভাবেই রবীন্দ্রনাথকে নিঃশব্দে লালন করা উচিত বুকের ভিতর, আর কুন্তল একটু আগেই বলেছে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতির অভিভাবক। আমি বলি রবীন্দ্রনাথ আমাদের অন্তরের অভিভাবক।

কুন্তল - রবীন্দ্রনাথ মানেই সেই সহজ অনন্ত অবাধ বিচরণক্ষেত্র। আর ঠাকুরদাদার কথা বললেই আমার ‘রাজা’ নাটকে ঠাকুরদার কথা মনে পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বয়সভারে জীর্ণ কোনো চরিত্র তৈরি করেননি; বরং তাঁর ঠাকুরদা প্রতিমুহূর্তে প্রাণের স্পন্দনে স্পন্দিত।

শ্যামসুন্দর -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঠাকুরদাদার ছুটি’ কবিতাটার কথা না বলে পারছি না  কবিতাটা নিতান্তই সহজ ছড়ার অঙ্গিকে রচিত কিন্তু আশ্চর্যরকম গভীর ও মর্মস্পর্শী তার আবেদন। “আমি তোমার চশমা-পরা বুড়ো ঠাকুরদাদা, / বিষয় কাজের মাকড়সাটার বিষমজালে বাঁধা। / আমার ছুটি সেজে বেড়ায় তোমার ছুটির সাজে, / তোমার কণ্ঠে আমার ছুটির মধুর বাঁশি বাজে।” এই চশমা-পরা বুড়ো ঠাকুরদাদা যিনি বিষয় কাজের মাকড়সার জালে আবদ্ধ তিনি আসলে রবীন্দ্রনাথের এক সীমাবদ্ধ আত্মপ্রতিকৃতি। সেই বদ্ধ সংকীর্ণতা থেকে ছুটির অন্বেষণ আসলে বৃহৎ অর্থে মুক্তি অন্বেষণ। আনন্দের খোঁজ।

সঞ্চালক -ঠাকুরদাদা থেকে এবার একটু কবিতার দিকে যাওয়া যাক। কবিতা-প্রশ্নটা সরাসরি তোমাকেই করছি, শ্যাম-দা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে তাঁর ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন ১৯০৯ সালে। উৎসর্গপত্রটি উদ্ধরনীয়।

শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
কল্যাণীয়েষু,
বয়সে তোমাকে অনেক দূরে পেরিয়ে এসেছি, তবু তোমাদের কালের সঙ্গে আমার যোগ লুপ্তপ্রায় হয়ে এসেছে এমনতরো অস্বীকৃতির সংশয়বাক্য তোমার কাছ থেকে শুনিনি। তাই আমার রচনা তোমাদের কালকে স্পর্শ করবে আশা করে এই বই তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের সাধনক্ষেত্র থেকে একে গ্রহণ করো।
তোমাদের
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এখন, আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক সাহিত্যের সাধনক্ষেত্রে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবি হিসাবে অবস্থান ঠিক কী রকম?

শ্যামসুন্দর - এই প্রশ্নটা ভীষণভাবেই একটা অপ্রথাগত প্রশ্ন। কিছুদিন আগে কবি নির্মল হালদার একটা চিঠিতে লিখেছেন- পৃথিবীতে একমাত্র কেউ যদি সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করে থাকেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। তাছাড়া আর সাহিত্য বলে কিছু হয় না এই একরৈখিক ধ্যানধারণাও কিছু মানুষকে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছে। কীভাবে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছে? তাঁরা বলেন আমরা রবীন্দ্রনাথ পড়ি, রবীন্দ্রনাথ বুঝি, আধুনিক কবিতা বুঝি না। কিন্তু এটা-তো একধরনের স্ববিরোধিতা। কিছুদিন আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা সাক্ষাৎকার টিভিতে দেখছিলাম। সেই সাক্ষাৎকারে অবধারিতভাবে ওঠে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ। ওঁকে প্রশ্ন করা হয় - আপনি কি মনে করেন আজ থেকে একশো বছর পরে আপনার কবিতা স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং তখনও তা পড়া হবে? উনি খুব অকপট ভঙ্গিতেই বলেছিলেন আমি একেবারেই মনে করি না একশো বছর পরে কেউ আর আমার কবিতা পড়বে বা মনে রাখবে। আসলে রবীন্দ্রনাথকে মানুষ মনে রেখেছে তার গানের জন্য। তাঁকে চিরদিন মনে রাখতে হবে তাঁর অপরিসীম গানের ভাণ্ডারের জন্য। ... একটা গানের উদাহরণ দিই। এবং এই গান নিয়ে আমাদের উত্তরাধুনিক চর্চার একটা নিদর্শন রাখছি । গানটি হল “ নিশীথের জলভরা কণ্ঠে কোন বিরহীর বাণী”| আমার এক অধ্যাপক-বন্ধু আমাকে এই গানটা প্রসঙ্গে বলেছিলো, মেনোপজের সময় মেয়েদের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে এমনই ইঙ্গিত রয়েছে এই গানটার ভিতর। তার মতে এক স্বনামধন্য রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ এমনই এক ব্যাখ্যায় উপনীত হয়েছেন। এই ধরনের চটকানো বা অহেতুক জটিল বিশ্লেষণ থেকে বেশ দূরে থেকে গেছে আদি ও অকৃত্রিম ভালোলাগা। মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

সঞ্চালক - এটাকে চটকানো বলছো কেন? এটা তো আধুনিক সমালোচনার একটা ধারাও হতে পারে ! তুমি তোমার অনুভবের জায়গা থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিরীক্ষণ করো, একজন অধ্যাপক তাঁর তীক্ষ বিশ্লেষণী মেধা ও মননশীলতার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে বিচার করেন  দুটোই স্ব স্ব স্থানে সম্পূর্ণ - কোনো বিরোধ থাকা উচিত নয়।

শ্যামসুন্দর -সেটা থাকা উচিত না অনুচিত সেটা তর্কের বিষয়। তবে কিনা রবীন্দ্রনাথ তাঁর অচলায়তন নাটকে মন্ত্র দিয়েছিলেন না - ওঁ তট তট তোতয় তোতয় স্ফট স্ফট স্ফটয় স্ফটয় ঘুণ ঘুণ ঘুণাপয় ঘুণাপয় ... এ যেন তারই নিদর্শন। এতে সহজাত প্রাণের আবেগ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই চুলচেরা বিশ্লেষণ ভীষণভাবেই জটিল। অন্তত আমার কাছে বড্ড বেশি জটিল এবং নিষ্প্রাণ বলে বোধ হয়। এটা হয়তো আমার সীমাবদ্ধতা; কিন্তু আমার মনে পড়ে যাচ্ছে প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর একটি কবিতার কথা । কবিতাটির নাম স্বীকারোক্তি ... কঠিন বিষয় আমি কখনও মানিনি / এই অপরাধ হোক জ্যোৎস্নার ভেতরে জানাজানি / যদি ক্ষমা করো ভালো, যদি ভর্ৎসনা করো তাও ভালো / এই সরলতা হোক জ্যোৎস্নার ভেতরে জানাজানি। ... এ আমারও স্বীকারোক্তি।

কুন্তল - এ প্রসঙ্গে আমার মনে হয় যে, রক্তকরবী নাটকে বিশুপাগল চরিত্রটি অধ্যাপকের চরিত্রের থেকে রবীন্দ্রনাথের বেশি কাছের। বিশু পাগলই যেন রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসাটা বেশি পেয়েছেন। আর শেষপর্যন্ত বিশু পাগলই আমাদের নিকটজন, অধ্যাপক নন। 

সঞ্চালক - ডাকঘর নাটকে অমল ঠাকুরদাকে বলেছে - “আমাকে তোমার ডাক-হরকরা করে দাও, আমি ওমনি লণ্ঠন হাতে ঘরে ঘরে তোমার চিঠি বিলি করে বেড়াব।”

কুন্তল -এটাই তো রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ের কথা।

কথায় কথায় কখন যে সময় বয়ে যায়। ঘড়িতে তখন বেলা দেড়টা। প্রত্যেক চলমান দূরভাষ মুখরিত হতে শুরু করেছে। রয়েছে পিছুটানের সংকেত। শিরীষ গাছের ছায়ায় রবীন্দ্রনাথের অনুরণন রিং-টোনে বাজে ... বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা এবার যার যার মত কেজো আলোচনায় মশগুল হয়ে উঠলাম। যাবার আগে সম্পাদকের প্রশ্ন , তাহলে আবার কবে বসা যাবে? ...
               আমাদের দ্বিতীয় দিনের অন্তরঙ্গ আলোচনার স্থান একটু বিচিত্র। পৌরসভা বাজারের পিছনে উজউঈ সভাগৃহের সামনে একটি নির্জন সিঁড়ির ধাপ। নিয়নল্যাম্পের হলুদ আলোর নীচে আমরা ক’জন। আজ আমাদের মধ্যে আছেন রাধানাথদা। রাধানাথ মুখোপাধ্যায়। রাধানাথদা একজন শিল্পী। শাস্ত্রীয় সংগীতসহ বিভিন্ন ধরনের গানে তাঁর অনায়াস যাতায়াত। রবীন্দ্রসংগীত তাঁর বিশেষ আগ্রহ ও ভালোবাসার স্থান। দেখা যাক আজ কী হয়...

সঞ্চালক - গায়িত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক লিখেছেন “If there is a buzzword in cultural critique now, it is marginality. (Spivak 35) Dwb AviI ejQb “Let us now move to consider the margins (One can just as well say the salient silent centre) of the circuit marked out by this epistomic violence, men and women among the illiterate peasantry, the tribals, the lowest strata of the urban sub proletariat” (Spivak 25) আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঐকতান কবিতায় স্বীকার করেছেন  - সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে। / মাঝে মাঝে গেছি আমি ওপাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে; / ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে। / কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন / কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন, / যে আছে মাটির কাছাকাছি / সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি। ... এটা কি কবির জবানবন্দি?  এভাবেই কি সমাজের উচ্চমঞ্চের সংকীর্ণ বাতায়ন অতিক্রম করে কবি পৌঁছে যেতে চেয়েছিলেন ওপাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে? নাকি এক ধরণের আত্মসমালোচনা যার মধ্যে দিয়ে কবি খুঁজেছেন উত্তরণের পথ?

রাধানাথ - রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব স্বীকারোক্তি হলেও আমি বলব এটা একটা মিথ্যাবাদ। রবিঠাকুর তাঁর সমগ্র সৃষ্টির ভিতর চিরদিনের মানুষের মানুষের কথা বলেছেন। ‘ওরা কাজ করে’ কবিতাটার কথাই ধরা যাক। এই কবিতাটা অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করলেই বোঝা যাবে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে অন্তহীন মানবশ্রমের চিত্র তুলে ধরেছেন। ‘ওরা’ বলতে তো রবীন্দ্রনাথ সেই ওপাড়ার প্রাঙ্গণের ধারের মানুষদের কথাই বলছেন। ‘ওরা’ তো সর্বক্ষেত্রেই সমাজের বাইরেই থাকেন। অন্তত শ্রেণীবিভক্ত পরিকাঠামোয় তেমনভাবেই তাদের রাখা হয়েছে।

কুন্তল - রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ... সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি ... মাটির কাছাকাছি একজন আশ্চর্য কবিকে আমরা পেয়েছি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়।

শ্যামসুন্দর - সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাদের জানিয়েছেন যে, একটা কবিতা লিখতে তাঁকে দস্তুরমতো হাঁটাহাঁটি করতে হত। রবীন্দ্রনাথ বোধহয় এমনটাই এক পদাতিক কবির জন্য কান পেতে ছিলেন। তিনি জানতেন ভবিষ্যতের কবিতা জনতার মধ্যে থেকে উঠে আসবে। কবিও হবেন সেই সাধারণ জনজীবনে চলাচল করা একজন সাদামাটা মানুষ।

সঞ্চালক - শুধায়োনা কবে কোন গান / কাহারে করিয়াছিনু দান / পথের ধূলার পরে / পরে আছে তারি তরে / যে তাহারে দিতে পারে মান। তুমি কি শুনছো মোর বাণী / হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি? / জানি না তোমার নাম, / তোমারেই সঁপিলাম / আমার ধ্যানের ধনখানি। ... নিজের গান সম্পর্কে এটাই রবীন্দ্রনাথের অভিব্যক্তি। শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘এ আমির আবরণ’ গ্রন্থে বলেছেন “রবীন্দ্রনাথের গান নিজেকে রচনা করার গান”। আজও কি রবীন্দ্রনাথের গান নিজেকে রচনা করার গান হয়ে ওঠে?

রাধানাথ - অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের গান নিজেকে রচনা করার গান। নিজেকে নিঃশব্দে নির্মাণ করার সংগীত। রবীন্দ্রনাথের গান আমার কাছে শুধুমাত্র সংগীতচর্চা নয় ,জীবনচর্চা ; জীবনের নিবিড়তাই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন। এই গান পাখির কলতানের মতই স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। সেজন্যই হয়তো এই গানের আবেদন সরাসরি পৌঁছে যায় হৃদয়ে।

সঞ্চালক - সকলের হৃদয়ে বোধহয় সরাসরি রবীন্দ্রসংগীত পৌঁছে যায় না। এ কারণেই বলছি যে এখনও প্রচুর মানুষ রয়েছেন যাঁদের কাছে রবীন্দ্রসংগীত অধরা। সেইসব মানুষের কাছে কি কোনোভাবে রবীন্দ্রসংগীত নিজেকে রচনা করার গান হয়ে ওঠে?

রাধানাথ - তোমার প্রশ্নের ওই কেন্দ্রবিন্দুতেই আমি ফিরব। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রসংগীত আমাদের আত্মার আত্মীয়। প্রশ্ন উঠতে পারে- এ কথা কি শুধুমাত্র নিয়মিত ও মগ্ন রবীন্দ্রসংগীত শ্রোতাদের ক্ষেত্রেই খাটে ? নাকি এর বাইরে সাধারণ মানুষজনের মধ্যে এর অস্তিত্ব আছে? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলি... আমি বর্তমানে হাজরাপুর জুনিয়ার হাইস্কুলের শিক্ষক। দুহাজার নয় (২০০৯) সালে ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে আমি যোগদান করেছি। আমার বিদ্যালয়ে সর্বমোট ১৬০ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই তাদের পরিবারের প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী যাকে আমরা বলি First generation learners. দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই আমার বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। সিংহভাগ ছাত্রছাত্রীই কৃষিজীবি বা ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক পরিবারের অর্ন্তভুক্ত। সেই একশো ষাটজন ছাত্রছাত্রীকে আমি কবিগুরুর “সব দিবি কে” গানটা শেখাবার চেষ্টা করেছিলাম। তারা বেশ কিছুদিন সেই গান অভ্যাস করার পর নিখুঁত সুরে সেই গানটা গেয়েছিলো।

কুন্তল - শুধু তাই নয়, সেই গান শুনে তোমার দাদা রুদ্রনাথ মুখোপাধ্যায় চোখের জল সম্বরণ করতে পারেন নি। একটা জিনিস এর থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে রবীন্দ্রসংগীতকে একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে মাটির মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। আমরা অনেকেই গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়াই কিন্তু ক’জন এরকম উদ্যোগ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছি? -এই নিশ্চেষ্ট বা নিস্পৃহ থেকে যাওয়াটা আমাদের সীমাবদ্ধতা। রবীন্দ্রসংগীতের নয়। রাধানাথদার এই প্রয়াস, উদ্যোগ প্রকৃতই প্রশংসনীয় ও সাধুবাদের যোগ্য।

রাধানাথ - না না কুন্তল, এ ক্ষেত্রে কোনো সাধুবাদই আমার প্রাপ্য নয়। এটা আমার কৃতিত্ব নয়। এই গানটা শেখা এবং সাবলীলভাবে পরিবেশন করা ওই ছেলেমেয়েগুলোর পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক। আমি আগেই বলেছি রবীন্দ্রসংগীত আসলে প্রকৃতির সংগীত। আর এই সব ছেলেমেয়েদের অবস্থান প্রকৃতির আঁচলের কাছে। প্রকৃতির আপনজন এইসব ছাত্রছাত্রীদের এই গান অনায়াসেই সম্ভব; সুতরাং আমার কোনো কৃতিত্ব নেই।

সঞ্চালক - রাধানাথদা এখনও পর্যন্ত ক’টা গান ওরা রপ্ত করতে পেরেছে?

রাধানাথ - আমি তো বললাম এটা আমার সক্ষমতা বা অক্ষমতার প্রশ্ন নয়। এই গান শেখাতে আমার কোনও পরিশ্রম হয়নি। এটা সম্পূর্ণই ওদের কৃতিত্ব। এখনও পর্যন্ত ওরা সাত-আটটা গান মোটামুটিভাবে আয়ত্ত করেছে। সবশেষে আমি ওদের শিখিয়েছি
                                      আমায় যে সব দিতে হবে
                                         সে তো আমি জানি।

সঞ্চালক - আপনি তাহলে ইতিবাচক অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাধানাথ - ইতিবাচক অনুঘটক ... (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) ... ইতিবাচক অনুঘটক কি না নিশ্চিতভাবে জানি না তবে এই গান গাওয়ার প্রভাবটা বোধহয় ওদের ওপর যথেষ্ট ইতিবাচক। কেন এই কথাটা বলছি তার উত্তর মিলবে যদি আর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। কিছুদিন আগে একক অভীক্ষার(Unit test) মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। যষ্ঠশ্রেণির বাংলার মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছি, যেসব ছাত্রছাত্রী আসছিল তাদের প্রত্যেককে আমি যে-কোনো একটা কবিতা আবৃত্তি করতে বলেছিলাম। আশ্চর্যজনকভাবে ৫৩জন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৫১জন আবৃত্তি না করে গান গেয়ে শুনিয়ে দিলো। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে আমি অনুভব করলাম কবিতা আর গানের আত্মা এক হয়ে গেছে।

কুন্তল - এটা সত্যই বিস্ময়কর । ঠিক যেমন রাধানাথদার হয়েছে । সব থেকে ভালো লাগছে এভাবেই বিভিন্ন প্রান্তে এখনও অনেক মানুষ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মধ্যে খুঁজে নিচ্ছেন আনন্দ আর প্রেরণা । তাঁদের এই রবীন্দ্রচর্চা হয়তো আমাদের জানা থেকে বহুদূর । আমার মনে হয় এ হলো একাকী মানুষের নিজের রবীন্দ্র-অন্বেষণ। এই অন্বেষণ হয়তো বা নিতান্ত সাধারণ । বিদগ্ধ কোনো সন্দর্ভ হয়তো এ থেকে তৈরি হবে না, কিন্তু মিলে যেতে পারে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। খুলে যেতে পারে আত্মআবিষ্কারের গভীর নির্জন পথ । 

রাধানাথ -এ প্রসঙ্গে একটা কথা তোমাদের জানিয়ে রাখি সর্বশিক্ষা মিশনের পক্ষ থেকে এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে একটা প্রোজেক্ট আকারে প্রস্তুত করার প্রস্তাব আমি পেয়েছিলাম। সবিনয়ে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি ।

সঞ্চালক - প্রত্যাখ্যান করলেন কেন ? প্রোজেক্ট হিসাবে প্রস্তুত হলে এই-পদ্ধতিটি হয়তো পশ্চিমবঙ্গের আরও অনেক বিদ্যালয়ে প্রয়োগ করা সম্ভব হতো ।

রাধানাথ - দেখো আমি আনন্দের জন্য এই কাজটা করার চেষ্টা করেছি । একটা সহজ স্বাভাবিক আনন্দ। আসলে আমাদের মধ্যে একটা সহজাত নান্দনিক বোধ নিহিত রয়েছে । কোনো এক অজানা মুহূর্তে অদ্ভুতভাবে সেই বোধ উৎসারিত হয় । আমার বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে । এটা প্রোজেক্ট নয়। কোনওভাবেই এটাকে প্রকল্পে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয় । সেরকম পূর্বপ্রস্তুতিও এর মধ্যে ছিল না  লক্ষ্যপূরণের দ্রুততা বা চাপ কোনোটাই অনুভব করিনি; কিন্তু অনাবিল আনন্দ পেয়েছি। গান শেখানো বা লেখা দুটোই ভীষণ সহজ আন্তরিক এবং আনন্দের অভিজ্ঞতা। আমার মনে হয় আজীবন কবিগুরু এই আনন্দের উপাসনাই করেছেন । সেই সাধনার সবথেকে সুন্দর ও মর্মস্পর্শী প্রতিধ্বনি রবীন্দ্রসংগীত।

ঘড়ির কাঁটা তখন দশটা ছাপিয়ে গেছে। আমার দূরাভাষে প্রতিধ্বনিত হল প্রত্যাবর্তনের প্রথম সতর্কবার্তা... কুন্তলদার দুচোখে ঝলসে উঠল সেই পুরোনো আলো.....এরপরেই এখনকার মতো আড্ডা বন্ধ করার ইঙ্গিত পেলাম আমরা। 

আমাদের তৃতীয় আড্ডাস্থল বাজারপাড়া। চিত্রকর সারথি দাসের বাড়ি। এই আড্ডায় সদস্যসংখ্যা নিতান্তই সীমিত। প্রথম পর্যায়ে সারথি দাস আর আমি...... এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভাল আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় পুরোটাই পূর্বনির্ধারিত । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রচর্চা.......।

সঞ্চালক - রবীন্দ্রনাথ বলেছেন......“আমি যা করি তাতে আমি আবদ্ধ নই। আমি যদি অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারতুম তবে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ছবি আঁকা ছেড়ে তাই করতুম। সেইজন্য ফর্মের প্রকাশের চেষ্টায় আমি মাঝে মাঝে ভাস্কর্যে হাত দিই। তাতে করে সুবিধা হয় এই যে সমান ফ্ল্যাট জমির সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে আমি বস্তুর চারিপাশে বেশ করে ঘুরে ঘুরে তাকে আরও ভালো করে নিরীক্ষণ করতে পারি, অধ্যয়ন করতে পারি...” আমাদের দেশের চিত্রশিল্পীরা সেইসময় রবীন্দ্রনাথ কে স্বীকার করতে পারেন নি। তার কারণ আছে । অশোক মিত্র বলেছেন তাঁর ছবির মধ্যে রোমাণ্টিক ভাবালুতা নেই, মঙ্গলচিহ্নের আলপনা নেই, কাব্যপনা নেই, নেতিয়ে পড়া , মেকি ললিতবঙ্গলতার উৎপ্রাস নেই । আছে যা তা ঋজু, কঠিন অস্থিকঙ্কালমজ্জাবিশিষ্ট অসুন্দর । প্রকৃত প্রস্তাবে কি রবীন্দ্রচিত্রকলার প্রকৃত নিরীক্ষণ বা অধ্যয়ন সম্ভব হয়েছে?

সারথি - ছবির নিরীক্ষণ বা অধ্যয়ন আমাদের দেশে ভীষণভাবেই স্বল্প ও সীমায়ত। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এটা একটা বিরাট ত্রুটি। আমাদের দেশে শিশুদের অঙ্ক শেখানো, ভাষা শেখানোর মতো ছবি দেখতে শেখানো হয় না । তুই হয়তো বলবি ছবি দেখতে শেখানো যায় না । এটা নিজের চেষ্টায় ধীরে ধীরে অর্জন করতে হয়। এটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনই সত্যি যে, ছবি দেখার একটা ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ ছেলেবেলা থেকে থাকলে দৃষ্টি প্রসারিত হয়। কীভাবে দৃষ্টি প্রসারিত হয়? আসলে কল্পনা সমৃদ্ধ হয় । এই সময়ে রবীন্দ্র চিত্রকলার নিরীক্ষণ বা অধ্যয়ন সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই কথাটা আমার প্রথমেই মনে হল । আমার মনে হয় নিরীক্ষণ, অধ্যয়ন আজীবন চর্চার বিষয়। চর্চা করতে করতেই ঋদ্ধ হয়ে ওঠে আমাদের চিন্তনশক্তি। এইভাবে একটা মননশীল সত্তার জন্ম হয়। এই সত্তার জন্ম কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত, কিছুটা অবশ্যই সুনিয়ন্ত্রিত, অধ্যয়ন, অভিনিবেশ ও প্রশিক্ষণ নির্ভর।

সঞ্চালক - তুমি শিল্পসমালোচনার ধারাটাকে সমৃদ্ধ করার কথা বলছ?

সারথি - এটাকে শিল্প সমালোচনা বলবি? আমি আসলে শিল্পরসিক হওয়ার কথাটা বলতে চাইছিলাম । দেখ ছবি আঁকাটা অন্যান্য সমস্ত শিল্পমাধ্যমের মতোই প্রাথমিকভাবে এবং প্রধানত স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর সৃষ্টিশীল তীব্রতা । ছবি আঁকাটা শুরু করেছিলেন প্রায় শেষ বয়সে। অথচ কী অসামান্য তীব্রতা আর অভিনবত্ব তাঁর ছবির ভিতর । ছবি আঁকার প্রবণতাটা তাঁর ক্ষেত্রে বাস্তবিকই ভলক্যানিক ইরাপসন্। একেকদিনে তিনি অনেকগুলো করে ছবি আঁকতেন। বলা ভালো, আঁকতে পারতেন। অনেক সুপ্রশিক্ষিত ও সুদক্ষ শিল্পীরাও এটা পারেন না। একটা তীব্রতা বা ইনটেনসিটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিকে ভীষণভাবে সজীব করে তুলেছিল। লেখার ক্ষেত্রেও তিনি কিন্তু চিত্ররূপময়। আমি তো তাঁর লেখার ভিতরও ছবির উদ্ভাস লক্ষ করি। ... ছায়ার ঘোমটা টানি/আছে আমাদের পাড়াখানি...... এটা যেন নন্দলালের লিনোকাট, অথবা ভীষণ পরিচিত একটা ব্ল্যাক এ্যাণ্ড হোয়াইট ল্যাণ্ডস্কেপ।

সারথিদার মুঠোভাষ মুখরিত হওয়ায় আমাদের আলোচনায় সাময়িক বিঘ্ন ঘটল... ফোনটা কুন্তলদার... কিছুক্ষণ পরেই ঘরে প্রবেশ করলেন আমাদের সম্পাদক। পরনে হলুদ গেঞ্জি, নীল জিন্স চোখের চশমা ঈষৎ স্থানচ্যুত (যেমনটা সাধারণত তাঁর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে আর কী ...)

সঞ্চালক - কুন্তলদা, সারথিদার মতে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা মস্ত গলদ হল আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থায় ছবি দেখা শেখানোর কোনো ব্যবস্থা নেই...এই ত্রুটির জন্য কি চিত্রশিল্পী হিসাবে রবীন্দ্রনাথের যথাযথ মূল্যায়ণ এখনও অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।

কুন্তল - (কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর) দেখো সৌতিক ছবি সম্পর্কে আমার কোনো সুস্পষ্ট বা সম্যক ধারণা নেই। সারথি এ ব্যাপারে আমাদের আলোাকিত করতে পারবে। সারথির কাছ থেকে ছবির আঙ্গিক সম্পর্কে আমি অনেক নতুন তথ্য ও তত্ত্বের কথা শুনেছি ও জেনেছি। চিত্রশিল্পী হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে আমার সম্পূর্ণ নতুন এবং আধুনিক শিল্পী বলে মনে হয়। তাঁর চিত্রে অবচেতনের আলো আঁধারির যে দুর্লভ প্রতিভাস দেখতে পাই তৎকালীন সময়ে সেটা ছিল ভারতীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক শিল্পরীতি। দুঃখের বিষয়, কূপমণ্ডূক এবং বিদ্বেষপরায়ণ সমালোচকদের পক্ষে রবীন্দ্রচিত্রকলার এই নতুনত্ব অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি। এই সময়ে সম্পূর্ণভাবে যে রবীন্দ্রচিত্রকলার মূল্যায়ণ হযেছে এমনটা নয়। যেটুকু হয়েছে তা সীমাবদ্ধ রয়েছে মুষ্টিমেয় উচ্চপর্যায়ের চিত্রসমালোচকদের মধ্যে। এই যে রবীন্দ্রনাথের ছবি একটা এলিট সোসাইটির ভিতর আবদ্ধ থেকে যাচ্ছে এর জন্য দায়ী কে? - অবশ্যই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ; শুধু শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি উল্লেখ করে যদি দায় এড়িয়ে যেতে চাই - তাহলে ভাবের ঘরে চুরি করা হবে । আমরা শিক্ষকেরা রবীন্দ্রনাথের ছবি সর্ম্পকে কখনও বা কোনোভাবে কি ছাত্রদের জানানোর চেষ্টা করেছি? করিনি । তার কারণ আমাদের সদিচ্ছার অভাব । এই প্রচেষ্টা শুরু হওয়া প্রয়োজন। ছাত্রছাত্রীরা জানুক চিত্রশিল্পী হিসাবেও রবীন্দ্রনাথ কী অসাধারণ ছিলেন!

সারথি - অসাধারণ তো বটেই, সে-সময়ের চিত্রশিল্পের প্রেক্ষাপটের দিকে যদি দৃষ্টিপাত করি দেখতে পাব একদিকে রয়েছেন রাজা রবি বর্মা, অন্যদিকে হ্যাভেল সাহেবের বেঙ্গল স্কুল এর পুরোভাগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর । রবি বর্মা রামায়ণের কাহিনিনির্ভর অসামান্য উজ্বল পৌরাণিক ছবি আঁকছেন । অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুঘল শিল্পরীতির মিনিয়েচার আর্ট অবলম্বনে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য চিত্র অঙ্কন করেছিলেন। স্বদেশচেতনাও তাঁর ছবিতে ফুটে উঠত প্রবলভাবে। উদাহরণস্বরূপ তার ‘ভারতমাতা ’ ছবিটার কথা বলা যেতে পারে। ঠিক এই সময় রবীন্দ্রনাথ যেটা করলেন সেটা বিস্ময়কর। তিনি তো আজীবন রূপের সাধক ছিলেন। সাধক ছিলেন বলেই বলতে পেরেছিলেন ... আমি রূপে তোমায় ভোলাব না...ছবি আঁকা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন কী হওয়া উচিত। এই অনুভবটা ছিল বলেই সমসাময়িক দেশীয় চিত্রজগতের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল তাঁর ছবিগুলো।

সঞ্চালক - আচ্ছা সারথিদা, কোনোভাবে কি এই অনুভব কবির দেখার ভঙ্গিকে প্রভাবিত করেছিল? পল ক্লী যে ঃযরহশরহম বুব এর কথা বলছেন চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের ভিতর বোধহয় সেটা সহজাতভাবেই ছিল.......।

সারথি - আসলে কী জানিস... ছবি দেখা তো শুধুমাত্র চোখের দেখা নয়, দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে ছবির আবেদন অন্তরের আরও গভীরে। ছবি দেখাটা হৃদয়ের দেখা। একটা নির্জন উপলব্ধি। সত্যজিত রায় বিনোদবিহারি মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে The Inner Eye বলে একটা তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে দেখেছি প্রকৃত শিল্পীর দেখা দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে দর্শনে উত্তীর্ণ হয়। এই অন্তর্দৃষ্টিটা ভীষণভাবেই প্রয়োজন । এছাড়া ছবির অনুধাবন বিশ্লেষণ কোনোটাই সম্ভব নয়।

সঞ্চালক - সারথিদা, এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না ..... keats এর Ode to a Nightingale কবিতায় কয়েকটা পঙক্তি আছে...
I can not see what / flowers at my feet, / Nor what soft incense / hangs upon the boughs / But, in embalmed / darkness, guess each / sweet ........ এই পঙক্তিগুলো ব্যাখ্যা করার সময় আমাদের মাস্টারমশাই  দুটি পঙক্তি উদ্ধৃত করেছিলেন ... চোখ খুললে যায় না দেখা / মুদলে পরিষ্কার। ... চোখ খুলে নয়, বন্ধ চোখেও স্পষ্ট দেখতে পাই রূপ...

সারথি - সেইজন্যই তো রবীন্দ্রনাথের ছবিতে রূপ ও অরূপের এক দ্বন্দ্বমুখর সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। তাঁর চিত্রে রূপ একাত্ম হয়ে ওঠে অরূপের সঙ্গে, কবি বলেছেন ... সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর। / আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।

সারথি - তিনি যখন লিখেছেন, লেখা চলাকালীন সংশোধন করেছেন- সেখানেও কাজ করছে তাঁর শিল্পীমন । কবিগুরুর পাণ্ডুলিপিগুলোও কী আশ্চর্যরকম চিত্রলোভামণ্ডিত। সংশোধন বা কাটাকুটির স্তূপ থেকে জেগে উঠছে অদ্ভুত অবয়ব। অন্য ধরণের এই ফরমটা কোনোভাবেই তথাকথিত গ্রাম্য আলপনার মঙ্গলচিহ্নের মতো নয়, এই doodles- গুলো কবি তো খেলাচ্ছলে করেছেন- অনেকটা যেন শিশুসুলভ মগ্নতায়। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। সেইজন্য আমার মনে হয় কবির আঁকায় কোথাও কোথাও একটা Child Art এর সহজ বিচ্ছুরণ আছে। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। আমার মনে হয় শিশুমনেও অরূপের অবভাস থাকে। শিশুরা যখন ছবি আঁকে তাদের অবচেতন থেকে তার স্বাভাবিক উৎসার আমরা লক্ষ করি। সেক্ষেত্রে Form টা গুরুত্বপূর্ণ নয়। পুরো চিত্রটাই একটা Concept এ পরিণত হয়। একটা ধারণা অথবা ধারণার খণ্ডাংশ। রবীন্দ্রনাথের ছবিটাও একটা সুনির্দিষ্ট চিত্র ধারণায় পরিবেষ্টিত নয়। এর ভিতরে রয়েছে বহুমুখী প্রবণতা। তাঁর ছবি আকারের ভিতর সম্পূর্ণ হয় না। সেখানে আপনা থেকেই নিরাকারের উপস্থিতি।

সঞ্চালক - ‘বহুমুখী প্রবণতা’ বলতে তুমি কী বলতে চাইছ ? তাঁর ছবিগুলো versatile না polyphonic?

সারথী - একই সঙ্গে versatile ও বটে polyphonicও বটে। Versatile এইজন্য যে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ versatile genius কোনোভাবেই স্থির, সীমিত বা সংকীর্ণ সত্তার মানুষ নন। প্রতি মুহূর্তে নতুন। তাই নিজেকে প্রকাশ করার, মেলে ধরার নিত্যনতুন মাধ্যম খুঁজেছেন। শেষ বয়সের সখা হিসাবে পেয়েছেন চিত্রকলাকে। polyphonic এই কারণে যে, ছবির ভাষা প্রকৃত অর্থেই বহুমাত্রিক, বহুস্বরসমৃদ্ধ। আর্ন্তজাতিক। বৃহৎ অর্থে ছবির language টা universal language । যে-কোনো চিরন্তন ভাষা একমাত্রিক বা সমস্বরের হয় না। আমার মনে হয় এই উত্তরাধুনিক অনুভবের প্রথম অনুচ্চারিত হোতা চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ। লেখক রবীন্দ্রনাথ নন। এটাও আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ভাবনা। তাঁর ছবি বহুমাত্রিক ও বহুস্বর সম্পন্ন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তার ছবি তো পুরোদস্তুর প্রশিক্ষণের অনুকরণের ফলাফল নয়। তাঁর ছবির ভিতর রয়েছে প্রকৃতির প্রাচুর্য, স্বতঃস্ফূর্ত উন্মাদনা। রূপ ও অরূপের মেলবন্ধন তাঁর চিত্রে এত সহজভাবে হয়েছে এই একটাই কারণে। তিনি জানতেন বিশ্বপ্রকৃতি চিত্ররূপময়। সেই প্রকৃতিতে রূপ ও অরূপের কোনো ভেদাভেদ নেই।

সঞ্চালক - কবিগুরুকে যখন তাঁর ছবির অর্থ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- “It is not for them to explain, but to express...” তার মানে উনি কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যখ্যায় সীমাবদ্ধ না হয়ে প্রকাশ করার আনন্দেই ছবি এঁকেছেন- কিন্তু বেশ কিছু বিখ্যাত সমলোচক তাঁর ছবির মধ্যে বীঢ়ৎবংংরড়হরংস এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব খুঁজে পেয়েছেন। কেউ কেউ বলেন তিনি পল ক্লী (Paul Klee) কান্দিনেস্কি (Wassily Kandinsky) এমিল নোলদের (Emile Nolde) ছবির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

সারথি - দেখ, এইসব তুলনার প্রসঙ্গে আমি যেতে চাই না। এগুলো প্রতিটাই বহুচর্চিত বিষয়। লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিত্রসমালোচকদের কথা। এর মধ্যে আমার নতুন করে আর কিছু বলার নেই। দু একটা কথা তবুও না বলে পারছি না। যেমন ধর পল ক্লীর (Paul Klee) ছবিতে অদ্ভুত একটা মিউজিক আছে। কবিগুরুর ছবিতেও সংগীতের অব্যক্ত মূর্ছনা অনুভব করা সম্ভব। অন্তত সেইরকম এক দ্যোতনা আমি খুঁজে পাই। কান্দিনেস্কির ছবির সঙ্গে কিছুটা হলেও রবীন্দ্রনাথের ছবির সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অনেক চিত্রসমালোচকের মতে এমিল নোল্দের আঁকা মুখোশ বা সধংশ-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অঙ্কিত অদ্ভুত বা কিম্ভুত অবয়বগুলির সাদৃশ্য রয়েছে। শিল্পসাহিত্যের জগতে এ নতুন কোনো ঘটনা নয়। রবীন্দ্রনাথের ছবির মূল জায়গা expression এর জায়গা। সেই সঙ্গে রয়েছে composition এর অভিনবত্ব। তাঁর ছবিতে form এবং space এর খেলা প্রকৃতি থেকে নেওয়া। যেমন ধর এই ছবিটা - Seven figures - ink on paper (59x46 cms IACC NOI 446) এই ছবিতে সাতখানা ফিগার রয়েছে; কিন্তু প্রাথমিকভাবে দেখলে মনে হবে এটা যেন একটা Landscape বা Hill scape। ছবিটার মধ্যে অদ্ভুত নাটকীয়তা আছে। মঞ্চ পরিকল্পনায় যে space-division থাকে; এই ছবিটার ভিতর সেই অনুষঙ্গ খুঁজে পাই। এখানে form সুস্পষ্ট হলে space অরূপ, আবার spaceটা কে যদি রূপ ধরি তাহলে form অরূপ। সেইসঙ্গে আলো তিনি সরাসরি নিক্ষেপ করেন না। আর ছবিতে আলো যেন গুহামুখে আলোর আভাস। এই আলো অবচেতনার উৎস থেকে উৎসারিত। এই আলো যেন অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত। এটা একটা মহাজাগতিক আলো (cosmic ray) | অথবা এই ছবিটার কথাই ধরনা Brooding-ink on paper (26.7 x 44.4cms : ACC No. 993) এই ছবিতে দেখ brooding এর অভিব্যক্তিটাই (expression) প্রধান। কবির ছবিতে form, space, colour, texture সবকিছুই মিলেমিশে অভিব্যক্তিটাকে একটা অসামান্য পর্যায়ে যায়। তাঁর Line-drawing ও অসাধারণ। Brushing এর মধ্যে রয়েছে গতি ও boldness। এবার অন্য একটি ছবির দিকে তাকানো যাক। Reclining figure - water colour - (36.5 x 26 cms)- এর মধ্যে নিহিত একটা (কিছুক্ষণ মৌন থেকে) condensed stony figure। ঘনীভূত প্রস্তরপ্রতিমা। পাহাড়টাকে যেন, personify করা হচ্ছে। প্রকাণ্ড এই পাহাড়। একইসাথে জীবন্ত, স্পন্দিত এবং প্রগাঢ়। ছবিটার নীচের তল ও ডানদিক বরাবর হলুদ অংশটায় কোনো এক জান্তব অবভাস। আবার এই হলুদ অংশটার ভিতর যেন পর পর অনেকগুলো প্রতিধ্বনি রয়েছে। এ যেন একটা echo-portrait.

কুন্তল - সারথি, তুমি একটু আগেই এই ছবিটার ভিতর পাহাড়টাকে ঢ়বৎংড়হরভু করার কথা বলছিলে... আমার মনে পড়ে যাচ্ছে বিশ্ববাংলা কবিতা উৎসবে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ভারততীর্থ কবিতার কথা উল্লেখ করেছিলেন। ... ধ্যানগম্ভীর এই যে ভূধর, নদীজপমালা-ধৃত প্রান্তর... তিনি বলেছিলেন পাহাড়ের সৌম্যকান্তি গম্ভীর ধ্যানমগ্নতার কথা। বহমান নদী যেন সেই সাধকের জপমালা। চমৎকারভাবে সেই চিত্রকল্পটার বর্ণনা করেছিলেন তিনি।

সারথি - আমাদের মনে রাখতে হবে ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু প্রকৃতিকে খুব নিবিড়ভাবে দেখেছেন। সুতরাং, তাঁর কবিতায়, ছবিতে, তাঁর সমস্ত সৃষ্টি জুড়ে প্রকৃতির স্বরূপ ফুটে উঠবে সেটাই তো স্বাভাবিক। ঠিক যেমন তিনি অনুভব করেছিলেন গাছ শুধুমাত্র গাছ নয়। এই ছবিটা লক্ষ কর -(A tree - Pen and ink - 21.5 x 27.9 cms : ACC No. 2627) এই ছবির মধ্যে চবহ ও রহশ এর নিজস্ব চরিত্র এবং গাছের স্বকীয় বিস্তার কোথাও যেন একাত্ম হয়ে গেছে। ভাব, একটা গাছের মধ্যে নিহিত রয়েছে একশো বছর বেঁচে থাকার নীরব সংগ্রামের অভিব্যক্তি। অবশ্যই অব্যক্ত অবস্থায় রয়েছে এই রূপটা। আমার চলা যায় না বলা /আলোর পানে প্রাণের চলা... এই silent struggle টা natural উপায়ে ফুটিয়ে তুলতে উনি চবহ ও রহশ সবফরঁস নিলেন। তাঁর আঁকা প্রকৃতির মধ্যে খোয়াই এর রুক্ষতা, ভুবনডাঙার মাঠের উদাসী আবহ দুইই অপরূপভাবে ফুটে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা তোদের জানিয়ে রাখি রামকিংকর বেজের যে ভাস্কর্যগুলো এখন শান্তিনিকেতনের চারিদিকে দেখা যায় সেগুলো নির্মাণে প্রথমদিকে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর সায় ছিল না। গুরুদেব কিন্তু সব দেখেশুনে রামকিংকরকে ডেকে বললেন আমার আশ্রমটা তোর মূর্তি দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারবি?

সঞ্চালক - সারথিদা, তুমি বললে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে আলো যেন গুহামুখে আলোর আভাস। ভ্যান গখের সূর্যমুখী ফুলের ভিতর যে উজ্জ্বল হলুদ রঙের ব্যবহার তা অদ্ভুতভাবে বিষন্যতা, melancholy আর neurosis এর কথা মনে পড়িয়ে দেয়, কবির ছবিতে আলোর প্রছন্ন রেখাপাত কি সেই বিষন্যতারই প্রতিফলন?

সারথি - না, রবীন্দ্রনাথের ছবিতে আলোর যে আপাত অস্পষ্টতা রয়েছে তার ওইরকম কোনো সহজ interpretation সম্ভব নয়। কবির গানে তো আলোর উচ্ছ্বাস রয়েছে। ছবিতে তাহলে আলো এইরকম অস্পষ্ট কেন? আসলে ভিতরে ভিতরে কবি ভীষণভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছেন একটা মুক্তির পথ। তিনি তো জানেন তাঁর দেশ পরাধীন। জাতি, জাতীয় সত্তা শৃঙ্খলিত; অথচ তাঁর বন্ধনহীন আত্মা এই পরাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই অন্ধকারের মধ্যে থেকেই শুরু হচ্ছে আলোর অন্বেষণ। যে আলো তাঁর ছবিতে অনুপস্থিত সেই আলো তিনি অবিরত খুঁজে চলেছেন। তিনি সন্ধান করেছেন স্বাধীনতার আত্মাকে। এই অনুসন্ধান প্রকৃতপক্ষে সমগ্র মানবাত্মার মুক্তির দিশা। এডওয়ার্ড মুঙ্খ (Edward Munch) The Cry বলে ছবিটার কথা মনে কর। ওই ছবিটার expression ভিতর রয়েছে সমস্ত পৃথিবীর কান্না ও তার অনুরণন। ওটা সত্যিই The cry of entire humanity.. রবীন্দ্রনাথের ছবিতে আলো সেই মুক্তির উদ্ভাস। যে মুক্তি আত্মার মুক্তি। যার মধ্যে রয়েছে সমগ্রকে অনুভব করার ও আত্মস্থ করার সমাহিত আকাক্সক্ষা। কিন্তু সেইসঙ্গে যেন তিনি এও বুঝতে পারছেন যে, সেই আলো নেই, সেই আলো এখনও বহুদূর।


No comments

Powered by Blogger.