আমার কবিতা যাপন : ঋক অমৃত




ঋক অমৃত




আমি ধীরে ধীরে, খুব বেশি পরিশ্রম না করেই হয়ত, তবুও জেনেছি একটা কবিতা কীভাবে জন্ম নেয়, আর একটা মানুষের বাচ্চা থেকে মানুষ হয়ে ওঠার মত করেই কীভাবে একটা এক্সপ্রেশন কবিতা হয়ে ওঠে। আমি খুব কাছ থেকে নয়, তবুও দেখেছি একজন কবিকে। কেন তিনি আত্মমগ্ন, স্বার্থপর, ব্যাক্তিগত। কিংবা আত্মস্থ, উদার, ইউনিভার্সাল। গ্রীক ভাষায় কবি অর্থাৎ স্রষ্টা। কোনো তত্ত্বে না গিয়েও বলা যায় কবি একজন স্রষ্টা। কবি কোনো নাম নয়, উপাধি নয়। যে কোনও মাধ্যম যা ক্রিয়েট করে, তাই আসলে একটি পোয়েট্রি।

কবিতা ! একটা স্মৃতি । একটা আকাঙ্ক্ষা । একটা অন্য যাপন । মেটিরিয়ালিস্টিক জীবনের প্যারালালি । হয়তো । অন্ধকার মাথার ভিতরে এক বোধ কাজ করে। সেও রহস্যময় । সংকেতে যেটুকু ধরতে পারি ।

একটি ফোটোগ্রাফ । অর্ণবের তোলা । ছবিটা দেখে অদ্ভুত একটা অনুভব হয় মনের ভিতর । তা যে কি জানি না । কিন্তু বুক হু হু করে ওঠে । আমার বাড়িতে বৃষ্টির মধ্যে একা ব্লাউজ ভিজলে তো মনে হয় নি । দেখিই নি কখনও। কিন্তু যখন সেটাই এই ছবিতে দেখি বাক রুদ্ধ হয়ে আসে । উদাস হই । তাহলে এটা কি কবিতা !


দিনা (আমার দিদা) মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করেন । আমাদের বাড়ির চা তাই খুব মিষ্টি হয় ।সিউড়ীতে গতবছর একটি নাটক ডিরেক্ট করি। সেই নাটকে অভিনয় করতে কয়েকজন বন্ধুকে ডেকেছিলাম কোলকাতা থেকে । আমার বাড়িই ছিল তাদের সেইকদিনের ঠিকানা। আর রোজ তাদের এই মিষ্টি চায়ের নালিশ যেত দিনার কাছে । মজা করেই । তাদেরই একজনের সাথে যখন আজ ফোনে কথা হচ্ছিল, আমাকে জিগ্যেস করছিল এই মিষ্টি চায়ের কথা । আমি বললাম, “আজ বিকেলের চায়ে দিনা চিনি দিতে ভুলে গেছে। প্রত্যুত্তরে শুনলাম, “ ওটা করিস না, এখন এই চায়ের মিষ্টি না খেলে পরে যখন পাবি না, খুব মিস করবি। এখন এই অনুভব কি কবিতা পড়ার পর হয় না!

যখন বারাসাত বিকল্পের অমলের চিঠিনাটকটি দেখি, ‘ডাকঘরএর একটি বিনির্মাণ, যেখানে অমল নিজে এসে রাজার চিঠি বিলি করে বেড়ায় সেটাও কি কবিতা নয় ! বা অপর্ণা সেনের দি জাপানিজ ওয়াইফ’ !
জানি না ! কিন্তু এই দৈনন্দিন কথাবার্তা, বা ছোট্ট ছোট্ট কিছু মুহুর্ত বা একটি বিশাল আয়োজন কখনও কখনও চেতনায় তার জাল বিস্তার করে। মনের শেকড় গুলো তখন ডানা পায়, আর ডানারা পায় শেকড়। এরাই কখন মনের ভিতর রচনা করে আশ্চর্য সব কবিতা । এদের নির্বাচন হয় না । যে আবিস্কার করছে এদের তার অনুভূতি আর তারপর যার কাছে পৌঁছাচ্ছে এই আবিস্কার তার অনুভব এই দুইয়ে মিলে আশ্চর্য এক সেতু রচনা হয়। একজন কবিও তো বোধ হয় তাই করেন।

পৃথিবীর সৃষ্টি একটা কবিতা । জল হাওয়া জীবনের সৃষ্টির কাব্য । প্রকৃতির মধ্যে কবিতা উড়ে বেড়াচ্ছে ঘুরে বেড়াচ্ছে । নিঃশ্বাস নেওয়ার মত করেই তাকে নিই । তারপর খাঁচার ভিতর সেই অচিন পাখি কেমনে আসে যায় তা অনুধাবন করার ইচ্ছেটা প্রবল হতে থাকে। জানার ইচ্ছেটা মাথাচারা দিয়ে উঠতে থাকে। শুরু হয় খোঁজ। একটা সত্যের খোঁজ। সেখান থেকে আসে প্রকাশের ইচ্ছা। জন্ম নেয় নাটক, সিনেমা, গান, ছবি বা নিছক কোনো গদ্য । কিন্তু শেষমেশ তারা সব্বাই একটা কবিতাই হয়ে উঠতে চায়। হয়ে ওঠার জন্য আন্দোলনও করে । এবার সব সৃষ্টিই যে কবিতা হয়ে উঠবে তাও নয় । যারা হয় না, তাদের মনেও পড়ে না।

আমার কাছে কবিতা এভাবেই আসে । ম্যাজিকের মত । অদ্ভুত একটা ম্যাজিকের মত । তারপর যখন তার প্রকাশ হয়, কাটাকুটি চলে । ততক্ষণ চলে, ঠিকঠাক নিজেকে সেই ইচ্ছের মধ্যে সমাহিত না করা পর্যন্ত । অন্যের এই প্রকাশ অবস্‌কিয়োরও মনে হতে পারে । যতক্ষণ সে আমার । আমার একার । তারপর আর নয় । যখন কবিতা কমিউনিকেশনের একটা মাধ্যম হয় তখন ঠিকঠাক কমিউনিকেট করতে পারাটাই আসল । এখানে অন্যেরও একটা দায়িত্ব আছে নিজেকে সেই কমিউনিকেশনের যোগ্য করে তোলার। যেমন করে আমি আমেরিকায় গিয়ে কেবল বাংলায় কথা বলতে পারি না, বা কোনো ব্রিটিশ এদেশে এসে। সেভাবেই । এবং এই পুরো প্রসেসটাই মানবিক এবং মানসিক ।

তাই মনে হয় কবিতা একমাত্র কবিদের জন্যই । পড়া বা লেখা বা দেখা । কেউ কবিতা লিখতে পারেন, কেউ পড়তে পারেন । কিন্তু কবিতা একটা যাপন । সত্যিকরেই । ব্যবহারিক জীবন থেকে দূরে নিজস্ব বোঝাপড়ায়। আমার ঘরের চৌকাঠ পেরোলে যে পৃথিবীটার মুখোমুখি হতে হয় আমাকে তার সাথে ফেসবুকের টাইমলাইনের যে সম্পর্ক, কবিতার সাথেও তার ঠিক তাই। ক্ষীণ । সমান্তরাল । ভারচুয়ালও । অথচ বিশাল । একটা ভালো কবিতা একজনকে সেই বিশাল জীবনের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে । সমস্ত আশা বা আকাঙ্ক্ষা বা স্মৃতি সমেত। যে পাঠক এই যোগাযোগে লগ ইন করতে সক্ষম নিজস্ব পাসওয়ার্ডে, তিনি কবি । কবিতা লিখুন আর নাই লিখুন ।

মণীশদা(মণীশ মিত্র) একটা কথা প্রায়শই বলে থাকে যে, ধরা যাক একজন অভিনেতা মঞ্চে পারফর্ম করছে যেন সে হাতের মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা ধারণ করে আছে, এখন সেই ফোঁটাটি যে আদৌ জলের ফোঁটা না অন্য কিছু এটা সম্পুর্ণ দর্শকের অনুভবের উপর নির্ভর করে। সেই দর্শক, সেই শ্রোতা, সেই পাঠকই কবি । যিনি তাঁর মনের সমস্ত দরজা খুলে এই ঘটনার সাথে নিজস্ব কল্পনা মিশিয়ে তৈরী করেন নতুন কোনো ইন্টারপ্রিটেশন । আর যে লেখক । তারা দশকের বা সংখ্যার নয় ।

আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই কথা অস্বীকার করা সত্যিই পলায়নবৃত্তি হবে যে কবিতা আজ পাঠক বিচ্যুত। পাঠকও কবিতা । অন্তত পশ্চিমবাংলায় । আট থেকে আশি সব্বাই একটা ফ্রাস্টেশনে ভুগছে। কোনো না কোনো কারণে । ঠিক যে বয়সে কবিতার প্রেমে পড়া যায়, সে বয়স সিলেবাসের চাপে আধমরা। কেরিয়ারের চিন্তায় তাদের নাভিশ্বাস উঠছে। জীবনে অবকাশ সত্যিই খুব কম। দুদণ্ড কথা বলার সময় যাদের কাছে নেই, যারা একে অপরের প্রতিবেশিকে চেনে না তারা কবিতা লিখবে বা পড়বে এমনটা আশা করাও অন্যায়। এদেরই মধ্যে থেকে যদি এক আধটা উঠে আসে তারা বড়জোড় চেতন ভগত হবে । আর কী ! কবিতাকে যদি এখন কোনো ভাবে টেস্টপেপারের মলাটে ফেলে পড়ানো যায় তাহলেই বোধ হয় এই ক্রাইসিস থেকে মুক্তি সম্ভব । নইলে ভাষার স্তন এফ এম চ্যানেলের আর জে দের টানাটানি আর চোষাচুষিতে একে তো ঝুলেছে আরোও ঝুলবে । সমাজও ।



No comments

Powered by Blogger.