গড়পঞ্চকোটে একদিন: ইন্দ্রদীপ দত্ত গুপ্ত




সময়টা ১৭৪০ সালের এপ্রিল মাস। আলীবর্দি খাঁ -র সেনাবাহিনীর কাছে হার মানতে বাধ্য হলেন বাংলার তৎকালীন নবাব সরফিরাজ খাঁ। রুস্তম জঙ্গ, সরফিরাজের জামাতা , উড়িষ্যার নবাব নাজিম একটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু তা যখন ব্যর্থ হল, তখন তিনি আলীবর্দি খাঁ কে ঠেকাতে নাগপুরের তৎকালীন মারাঠা শাসক রাঘোজি ভোসলের কাছে সাহায্য চাইলেন। ফল হল মারাত্মক!  আজকের পাঞ্চেত বাঁধ যেখানে, সেই অঞ্চল দিয়ে অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যরা দলে দলে বাংলায় প্রবেশ করল আর প্রায় দশ বছর ধরে ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বাংলায় শোষণ আর লুঠপাঠ চালিয়ে গেল। বর্গী অর্থাৎ মারাঠা সৈন্যদের অত্যাচার এক কলঙ্কময় অধ্যায় হয়ে দেখা দিল বাংলার ঘরে ঘরে। শেষ পর্যন্ত ১৭৫১ সালে মারাঠা রাজা ও তৎকালীন বাংলার নবাবের সন্ধিপ্ত্র সাক্ষরিত হওয়ায় এর অবসান ঘটে। এরই মাঝে কোনও এক সময় বর্গীদের আক্রমণে গড়পঞ্চকোটের পতন ঘটে। কালের প্রবাহস্রোতে আর আমাদের অবিমিশ্রকারিতায় যা এখন ধবংসস্তুপে পরিণত। তবু আজও,এখনও যা অক্ষুণ্ণ আছে তা ও ফেলনা নয়।

 দাঁড়িয়ে আছি সেই খন্ডহরের সামনে। কাছাকাছি বড় ছুটি না থাকায় ছোটো ট্যুরের খোঁজ -করছিলাম। বাঙ্গালীর চিরকালীন দীঘা, পুরী থেকে শুরু হল জায়গার তত্ব_তলাশ। এরই মাঝে কে যেন সেদিনের কাগজে প্রকাশিত একটা ছোট্ট খবরে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ' পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন দফতর ' এর গড়পঞ্চকোট বনবাংলো এই বছর সবচেয়ে বেশি আয় করেছে। কৌতূহল হল, এমন কী জায়গা যেখানে পর্যটকের আনাগোনা গরুমারা বা জয়ন্তীর চেয়েও বেশী ! ব্যাপারটা "কালটিভেট" করতে হানা দিলাম গড়পঞ্চকোট।




 জায়গাটা এমন কিছু দূরে নয়। আসানসোল- বরাকর পেরিয়ে কুমারডুবি। সেখান থেকে গাড়ি বা ট্রেকার ভাড়া করলাম। মিনিট চল্লিশের পথ। কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলে ঘেরা বনবাংলো  আমাদের স্বাগত জানালো। পিছনে অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাঞ্চেত পাহাড়। বাংলোয় ডরমিটরি থেকে শুরু করে এসি রুম পর্যন্ত আছে। জীবনের প্রথম মুহূর্ত থেকে যেমনি ভাবে আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে প্রকৃতি তেমনি ভাবেই এখানে প্রতিটা ঘরের নাম  রাখা হয়েছে গাছের নামে। আমাদের ঠাই হল শাল, পিয়াল আর মহুয়ার তত্বাবধানে।

 পরদিন প্রাতরাশের পর গেলাম গড় দেখতে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল বড় বড় পুকুর। আসলে পুরো কেল্লাটা ঘেরা ছিল পরিখা দিয়ে। তারই অবশেষ হিসাবে পুকুর গুলো রয়ে গেছে। গ্রামের লোকের পাঁচিল বা বাড়ির কাঠামোর অঙ্গ হয়ে গেছে গড়ের কোনো না কোনো অংশ। হয়ত বা সেখানে কোনও দরজা বা ফটক ছিল যা এখন বাড়ির পাচিলের অংশ হিসাবে শোভা পাচ্ছে। আরও একটা জিনিস দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। সেটা হল আমাদের এখানে যেমন শর গাছ দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি এক ধরনের গাছ। যেখানে রয়েছে, সেখানে অপর পাড়ে কি আছে তা দেখাই যাচ্ছে না। দুর্ভেদ্য এক দেওয়াল খাড়া করে রেখেছে যেন ! স্থানীয় লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেল এটা বাঁশ গাছের একটা প্রজাতি। এতটাই দুর্ভেদ্য যে একে ছাগল বা কুকুর ও এড়িয়ে চলে। এমনকি সেকালে শ্ত্রু হানা এড়ানোর জন্যেও এর ব্যাবহার ছিল। এখন গড়ের ধ্বংসাবশেষ পুরোটাই ছেয়ে আছে এই বাঁশ গাছের জঙ্গলে। আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে চোখে পরবে বিষ্ণুপুরের পঞ্চরত্ন মন্দিরের আদলে তৈরি একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। কাছাকাছি পাথরের তৈরি আরো কিছু স্থাপত্য চোখে পড়ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ টাই অগম্য। ঘন ঝোপঝাড়ে ঢাকা। অযত্নের ছাপ সর্বত্র।

ক্রমশঃ সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। অস্তমিত সূর্যের আলোয় অপার্থিব দেখাচ্ছিল মন্দিরটা। ফেরার জন্য যখন গাড়িতে উঠছি তখন হঠাৎ লোডশেডিং। অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল সমগ্র গড়পঞ্চকোট। আমাদের ইতিহাস চেতনার মতোই।

1 comment:

Powered by Blogger.