'এ শহরে আর নেই তোমার আমার জন্য সুস্থ মধ্যরাত'



অনির্বাণ মজুমদার


একটি কাব্যগ্রন্থের কবিতার প্রথম পংক্তি 'যতটা দূরত্ব রাখো, আমি তত স্পর্শ করতে পারি'; এরকম একটি নিবিড় চেতনা নিয়ে শুরু হয় 'যে গান রাতের' বইটি কবিতাগুলোয় কবি ধরতে চেয়েছেন জীবন-দর্শন, তার নিরিখে পৃথিবীর সমসাময়িক পরিস্থিতি , উসকে দিয়েছেন কিছু পুরনো প্রশ্ন, রেখেছেন কিছু পরিচিত সংকেত রাজনৈতিক অরাজকতার যন্ত্রণা ফল্গু ধারার মতো রয়ে গেছে বেশিরভাগ কবিতাতেই, কবির প্রতিক্রিয়া এ ব্যাপারে লক্ষণীয়- কারণ, তিনি এ সবের মধ্যে থেকেও বহু দূরে কোন এক নির্জন পাহাড়চূড়া থেকে সবকিছু লক্ষ্য করছেন, লক্ষ্য করছেন এ সবের মধ্যে মিশে থাকা 'নিজেকে' - 'এ জগৎ আমি, যাকে তুমি ভাবছো শান্ত পঞ্চভূত/ তুমিও আমার রূপ, আমিও তোমার'
কিন্তু এ পৃথিবী নিষ্কৃতি দেয় না মানুষকে - উচ্চাকাঙ্ক্ষা , শঠতা , স্বার্থসিদ্ধির চাপে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে সবাই, তখন 'মানুষ হো হো করে হাসছে আর পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে শয়তান', সেই মানুষ ,                 মানুষ বারবার ফিরে এসেছে হিন্দোলের লেখায়, তিনি মানুষকে ভুলতে পারেন না , যেমন ভুলতে পারেন না শহরকে , ভুলতে পারেন না মা-কে , ভুলতে পারেন না ঈশ্বরকে- সবই এক হয়ে তৈরি করে মহার্ঘ প্রকৃতি , যাকে তিনি পুজা করেন , ভালোবাসেন- 'প্রেমিক বা ভক্ত সে তুমি আমাকে যে নামেই ডাকো' , তিনি জানেন 'এই যে নগরী, গ্রাম , মফস্সল , মুখোমুখি জেগে থাকা গাছ/ সমস্তই ঝরে যাবে, মহেঞ্জোদারোর মতো মাটিতে লুকিয়ে পড়বে/ আত্মীয়বান্ধব , শোক , কথাবার্তা, প্রেম, স্বপ্ন, নশ্বরতাগুলো' , তাই বলেন 'জলের অপর নাম লিখো না , স্রোত ভুলে যায় কোথায় উৎস ', তিনি এক শাশ্বত স্থায়িত্বের কথা ভেবে আহ্বান জানান 'বরং পাথরে লিখি   চলো, শ্রমে ক্লান্তিতে লিখি আমাদের শ্লোক/ যা মুছে যাবে না শুধু পুড়ে যেতে যেতে' , জন্মান্তর স্নেহ ও সমর্পণের কথা ফিরে ফিরে আসে  এই বইয়ের পাতায় - 'হাজার বছরের নাভি ভেসে যায় দিকচক্রবালে/ আমিই  ভাসাই আর আমিই তোমার সামনে হাত পেতে বলি- জন্ম দাও'- এ চিন্তা সনাতন, কোন সামান্য হিন্দু গোষ্ঠীর এঁকে দেওয়া তিলক নয়, 'মা' কবিতাটি সেই চিরকালের বিসর্জন-আবহনের প্রক্রিয়ার অনন্ত চক্রকেই ব্যক্ত করে এই জন্মমৃত্যুর, আসাযাওয়ার চক্র বইয়ের বেশ কিছু কবিতায় প্রকট
হয়তো তৃষ্ণার্ত হিন্দোল  যাত্রাপথে কোথাও রবিবাবুর গস্পেল থেকে একপাত্র জল পান করেন -  ' বহুবছরের খেলা বুঝি,  হয় না শেষ বলে,/ বারবার ফিরে আসি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাই চলে / স্রোত মিশে যায় স্রোতে,  কাল হয়ে কালে' তিনি অনুভব করেন  '' সঃ বৈ  এষঃ মহান অজঃ আত্মা অজরঃ অমৃতঃ অভয়ঃ ব্রহ্ম"  (বৃহদারণ্যক উপনিষদ) আর  কলম লিখে ফেলে ' আমাদের মৃত্যু নেই, জরা নেই, জন্ম নেই'
         ফিরে আসি মানুষের কথায়, মানুষের অবস্থায় কবি যতটা সহমর্মী ততটাই আতঙ্কিত তাদের ব্যবহারে, যেমন  
         () 'আজ কথায় কথায় আমরা একে অপরকে দোষারোপ করছি'
() 'দেখি সব মানুষের হাতে/ গাছ পোড়ানোর গন্ধ, মাটির শুকোনোর হিংসা, নদীহননের অহংকার'
()'মানুষ হাহাকার করতে করতে ভুলে যাচ্ছে ঠিক কি কারণে/ তাদের রুখে দাঁড়ানোর কথা ছিল'
()'যে মানুষ একলা হয়ে যায়/ তার/ স্বপ্ন থাকে না'
()'কয়েকটি শকুন ওড়ে, মানব সভ্যতা বুঝি ভাগাড় এখন?'
প্রথম দুটি পঙক্তিতে আতঙ্ক ও তারপরের দুটিতে সহমর্মিতা লক্ষ্য করা যায় শেষেরটির তীব্র ব্যঙ্গ-ব্যঞ্জনা পাঠকের চোখ এড়াবে না  কিন্তু প্রশ্ন হল এসবের কারণ কী? যার জন্য এত ব্যথা, চিন্তা... তার ভয়ে আবার জড়োসড়ো হয়ে থাকা কেন ? মনে আসে দার্শনিক ফুকো- কথা-
" People know what they do; frequently they know why they do, what they do; but what they don't know is what - what they do does."  
- Michel Foucault, Madness and Civilization: A History of Insanity in the Age of Reason
    এর উত্তর দিতে পারে একমাত্র রাজনীতি,  রাজনীতিই মানুষকে মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে এর পরিষ্কার একটা চিত্র তুলে ধরে 'সংক্রান্তি' নামক কবিতাটি নজিউমারিজম থেকে ঈর্ষা, ধর্ম থেকে অন্ধতা,  ক্ষমতা থেকে সন্ত্রাস -  এইসব বিষ হয়ে ঢুকে গেছে আমাদের শরীরে, 'রক্তে বিষ মিশে থাকে নিরাপদে এ শহরে' , আবার ফিরে আসি ফুকো-  কথায় ''The strategic adversary is fascism... the fascism in us all, in our heads and in our everyday behavior, the fascism that causes us to love power, to desire the very thing that dominates and exploits us. "   হিন্দোল জানিয়ে দেন এও ' গান তোমাদের ধর্ম নয়, তাই অস্ত্র হাতে ধর্ম দিয়ে মারো'  বা 'এখন চারিদিকেই আগুন/ হিংসা কোন দুঃখ মানছে না' , তুলে দেব দার্শনিক কৃষ্ণমূর্তির কয়েকটি লাইন - " And not finding this nameless thing of a thousand names which he has always sought, he has cultivated faith - faith in a saviour or an ideal - and faith invariably breeds violence", তিনি দৃশ্য আঁকেন সেই আন্ধকারের -  ' শহরের সমস্ত জানলা বন্ধ/  এলোমেলো উড়ছে খবরকাগজ, পোস্টার আর দমবন্ধ আশাবাদ/ তোমাকে বাঁচানো যায়নি'  এভাবেই বোধহয় আমাদের প্রতিবাদী সত্তার মৃত্যু ঘটে -  ' এই মৃত্যু ধর্মহীন,  এই মৃত্যু চির-অন্ধকার'  মনে পড়ে আইরিশ কবি ইয়েটস- এর বিখ্যাত 'The Second Coming' কবিতাটির কিছু পংত্তি - '        
Things fall apart; the centre cannot hold;
Mere anarchy is loosed upon the world,
The blood-dimmed tide is loosed, and everywhere
The ceremony of innocence is drowned;
The best lack all conviction, while the worst
Are full of passionate intensity.
উক্ত আশাবাদ কে নিয়েও আরেক জায়গায় ঠাট্টা করেছেন কবি যেন তা 'হ্যাঙ্গার থেকে ঝুলছে'  এখানে ঢুকে পড়ছে বিষাদ,  এক সর্বজনীন বিষাদ যা বহুবছর আগে বরানগরের এক তরুণ কবির রক্তে 'বিষ' মিশিয়ে দিয়েছিল, প্রেমিকা সুপর্ণাকে তিনি বলেছিলেন যে তিনি 'ঘুমিয়ে'  থাকতে চান,  যে 'ঘুমের' আর্তি  ছড়িয়ে রয়েছে হিন্দোলের এই কবিতাগুলোর ভেতরেও বিষাদ অবশ্যম্ভাবী,  তাকে এড়ানো  শুধু কঠিনই নয় -  যেকোনো সচেতন মানুষের পক্ষে অসম্ভব;  অন্তত আজকের দিনে,  যখন আমরা স্মরণ করি - 'পৃথিবীর সমস্ত আত্মহত্যা মৃত্যুর চেয়েও বেশি দুঃখ পেয়েছিল' ,  দেখি যে ' পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কূটকচালি, দুঃখবোধ আর বিষাদ', ভাবি সত্যিই কি ' হৃদয়ের অনিশ্চয়তায়/ যে সব দরজা জানলাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, সেইসব কানাগলি থেকে/ বুকে ব্যাথা হয়?' যার ' কাছে গেলেই নীল রঙা এক দুঃখ ছুটে আসে' বিষাদ, অন্তর্ঘাত, দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাস থেকে কিন্তু আমরা শেষ পর্যন্ত বাঁচতে চাই, বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছেটুকুই আমাদের ভেতরে সদা উজ্জ্বল, 'ছুরি ও হত্যার মধ্যেকার দূরত্বে ' হিন্দোল লেখেন ' এই শেষ সুযোগ, এসপার-ওসপার হয়ে যাক, ঘুরে দাঁড়াতেই হবে', আগামীকালের প্রতি তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ -  ' একটি সামান্য বীজ হয়ে আমিও পৃথিবী বাঁচাবো তোমায়'  
এই বেঁচে থাকার অভিব্যক্তি থেকেই হয়তো জন্ম নেয় ঈশ্বর বা প্রকৃতিচেতনা - যার উল্লেখ আগেও করেছি   সেই পরশপাথরের সন্ধান করেন কবি -  ' সহজ করে তোমায় খুঁজি, জটিল করে বলি, / পাইনি তাই খুঁজে চলাই ভাল ' ,  মনে মনে জানেন যে ঈশ্বরও ভক্তের অপেক্ষায় থাকেন - ' যদি না আমার চোখ/ তোমাকে খুঁজে পায়, জানি তুমি আমাকে দেখেছ',  এবার লেখায় সাধক রুমির দর্শন ছায়া ফেলে - 'যখন তোমাকে দেখি,  তোমার চোখেই দেখি তোমাকে আবার'  বা 'যার কোনো দিক নেই, তার সবদিকেই ঈশ্বর'  সে ঈশ্বর  কবির পরমাত্মীয়,  যার বিদায়বেলায় কবির অভিমান হয় - 'ঘট ভেঙে চলে যেতে যেতে/ একবার তাকাবে তো ফিরে ? '  
'সহযাত্রীকে'  এবং 'আঁধার' কবিতা দুটিও একবার পড়লে মনে থেকে যাবে পাঠকের ' সতর্কতা ' কবিতাটি সেলাম জানায় আমাদের প্রিয় 'পদাতিক কবি'-কে গোটা বই জুড়েই হিন্দোল কিছু সংকেত, মেটাফর,  সতর্কবার্তার জাল বুনেছেন, বিভিন্ন অবস্থার -  এগুলো হিন্দোলের ব্যক্তিগত  দর্শন থেকেই উঠে আসে;  তা ব্যঙ্গাত্মক হতে পারে  ('প্রসাধন কতটুকু সত্যি কথা বলে?'),  উপদেশ-মূলক হতে পারে (' আকাশ যেখানে নামে, সেখানেই নৌকা হওয়া ভাল '),  আবেগপ্রবণ হতে পারে ('সাড়া পাব বলে আমি কোনদিন তোমাকে ডাকি না'),  কোথাও বা প্রেমের ( ' তুমি তার হাত ধরে কতদূর যাবে প্রিয়তমা/ ফিরে আসতে হবে বলে বারবার কেন যেতে হয়?') এবং কোথাও কোথাও তা অতিজাগতিক পরাবাস্তব প্রেক্ষাপটের দিকে টেনে নিয়ে যায়  - ' কোনদিন ঘড়ির সাথে কথা বোলো না /  কথা বলো না কম্পাসের সঙ্গে /  ওরা কোথাও যায় না ' এই বইয়ের পরিসর বৃহৎ, প্রতিটি কবিতার ভেতরে পোঁতা আছে এক সম্পূর্ণ সুদীর্ঘ কাহিনীর বীজ, যার অসংখ্য চরিত্র আমাদের কাউকে-না-কাউকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করে কবি এখানে ভয়, বিপদ বা অভিজ্ঞতার সূত্রগুলো রেখেছেন  একেবারে নিজস্ব ভঙ্গিমায়,  যথাক্রমে - ' কত সরু রাস্তা হলে তবে অন্ধগলি শুরু হয় ?',  ' হাত ছেড়ো না, যে যাই বলুক, আমরা ঝড়ের বার্তা জানি'  এবং ' ক্ষুদ্র হোক,  তবুও সে আলো ' এরকম বিভিন্ন স্তরের উপলব্ধি কবি ভাগ করে নিয়েছেন খুবই সহজ অথচ গভীর শব্দচয়নের মাধ্যমে হয়তো জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেতে ' এইসব শহরে কার্নিশ থেকে দূরে যেতে হবে',  তার আগে হিন্দোল স্বপ্নের ভেতরে শেষবারের মতো ঘুরে আসেন বরানগরের বেনিয়াপাড়া লেনের চিলেকোঠায়,  নিচুস্বরে বলেন ' প্রণাম হে জীবন, প্রণাম সমর্পণ আমার / গাছ থেকে ঝরে যাওয়া সবুজ পাতা,  শোনো, / তুমি বেঁচে থেকো আরও ক'টা দিন'





 

No comments

Powered by Blogger.