মথ ।। গদ্য সংখ্যা ।। দুই

শুভ্রা দত্ত রায়

আকাশ আমায় ভরল আলোয়

.
জ্যেঠু বললেন "সা লাগাও"... সে দেখলো যোধপুর পার্কের আকাশ গরাদ গলে ঢুকে এলো জানালায়।সে এসে এখানেই বসে।জানলার পৈঠায়।গুলঞ্চ গাছটি পাতা দোলাচ্ছে, একটা হলুদ হলুদ রেশম রেশম পাখি টি টি করে ডাকছিলো। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে--কালো পুঁতি পুঁতি চোখ। সে ভয় পেলো একটু? চোখ দেখলে ভয় পায় সে? তার গোলাপি সুতির ফ্রক বড়োসড়ো, পা ঢেকে বসেছে। মা বলেছেন--" তুতুল!! বড়ো হয়ে গেছো। মনে রেখো জ্যেঠুর মতো ঈশ্বরতুল্য মানুষ তোমায় গান শেখাতে রাজি হয়েছেন, এটা মস্ত ভাগ্য। শান্ত হয়ে বসে থাকবে, কথা শুনবে, কত মান্যগন্য মানুষ আসবেন, কত গুণী ছাত্রছাত্রী। শেখার চেষ্টা করবে। তোমায় শিখতে হবে।"
সে জানে না তাকে কী শিখতে হবে। কীভাবে শিখতে হয়? শুনে শুনে সুরগুলো গলায় তুলে নিতে হবে? আর কথাগুলো? মা যেমন শেখান, রান্না করতে করতে-- "নীল দিগন্তে, ওই ফুলের আগুন লাগলো, লাগলো"--- সেইরকম? সে কেবল ভুল করে; "বসন্তে" বলার আগে দম নেওয়ার জায়গা নেই, সে থেমে গেলেই মা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকান; সে তাড়াতাড়ি সুর লাগায়। সেইরকম? শিখতে হবে?

জ্যেঠু বললেন "সা লাগাও"। সে মুখ ফিরিয়ে বসলো। সা রে গা মা শিখবে নাকি? ইশশ। সে টি ভি অডিশন পাশ করে গেছে। সোলো প্রোগ্রাম। সামনে ঘরজোড়া কার্পেট। দুটো ময়ূর। রাধাকৃষ্ণ। লাল আর সবুজ। নীল আর গোলাপি। অর্পিতাদি আর অরিন্দমদার হাতে জোড়া তানপুরা। মায়ের তানপুরার মতো নয়। ছ'টা তার। গম্ভীর মেহগনি রঙ। উপরে ইংরাজিতে লেখা নস্কর'স। বাব্বাহ। সুজয়কাকু জার্মান রিডের হারমোনিয়ামে একবার এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত আঙুল বোলালেন। উজ্জ্বল হলুদ পাথর। কেমন আওয়াজ। যেন নদীর জলে পাথর ছুঁড়ছে সে আর দাদাভাই। হৃষীকেশের গঙ্গায়। জ্যেঠু বললেন"সা লাগাও"। তারপর চোখ বন্ধ করে সা বললেন। অরিন্দমদা সুজয়কাকুর দিকে ঝুঁকে পড়লো--"সি শার্প"। সে দেখলো পাখিটা একইভাবে বসে আছে। গুলঞ্চ গাছের পাতা কাঁপছে। কালো মেঘ নেমে আসছে গরাদ ধরে দাঁড়াবে বলে। ভজন আশ্রমে ঘন্টা বাজছে। ঢং। ঢং। তানপুরার খরজে আঙুল অর্পিতাদির। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। একেই কি "ঈশ্বরতুল্য" বলে?

জ্যেঠু বললেন--" ঋতা! ওর গলায় কিন্তু নিজস্ব ঘূর্ণন আছে। রাগসঙ্গীতের জন্য বেশ আইডিয়াল। তুমি যে হার্শনেসের জন্য চিন্তা করছো, সেটা আসলে ওর রেঞ্জের জন্য। এত চমৎকার রেঞ্জ তো নষ্ট করা যায় না। মহিলাকন্ঠ হলেই বেসের নোট ভালো হবে, হাই পিচ হবে না-- এরকম কোনও রিজিডিটি রেখো না। সময় লাগবে, রেওয়াজের ধরনটা বদলাতে হবে। আর ওসব টেলিভিশন, রেডিও, কম্পিটিশন নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না এত। এখন সুরের জন্য ভালোবাসা তৈরি হোক, পেশাদার হতে সময় লাগে না।"
 সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। লম্বা টানা করিডোর। কাচের গায়ে ঝলমলে রামধনু, পাল্লাগুলো খুলে দেওয়া যায়। আজ মা তাকে নিতে এসেছে। অন্যদিন অর্পিতাদির গাড়িতে সে বাড়ি ফেরে। অরিন্দমদা আর্পিতাদি তাকে আদর করে, গাল টিপে দেয়। তার ভালো লাগে না। সে তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে গাল ঝেড়েঝুড়ে আদর ফেলে দেয়। ওরা দুজনেই হাসে। তারপর হাত ধরে গাড়ির সামনে নিয়ে যায়, কোলে করে তুলে বসিয়ে দেয় সামনের একটেরে সিটে। এইটা তার খুব পছন্দ। সে একা। পাশে ড্রাইভারকাকু, আলাদা সিট। পিছনে দিদি আর দাদা। কিন্তু এত আস্তে কথা বলে কী করে? সে বেশির ভাগ কথাই শুনতে পায় না। একেকদিন ওরা গান নিয়ে আলোচনা করে।
--তুই দেখেছিস ভৈরোঁর রেখাব কোমল হলেও গুরুজী কিভাবে লাগালেন? স্ট্রেইট নয়। একটু গান্ধার ছুঁয়ে এলেন।
--হ্যাঁ। ওটা কিন্তু তুই হারমোনিয়াম বা তানপুরায় করতে পারবি না। সুরমণ্ডলে আসে রে?
--কী জানি! আমার তো হারমোনিয়াম নেই। গুরুজীর পুরোনো তানপুরা না পেলে রেওয়াজ বন্ধ হয়ে যেতো।

সে উৎকর্ণ হয়। অরিন্দমদার তানপুরা নেই?? হাঃ। সত্যি? আজ জ্যেঠু ভৈরোঁ শেখানোর সময় যখন বললেন-- "হারমোনিয়াম বন্ধ রাখো। শুধু খরজে তান করো।" অরিন্দমদা কেমন অবলীলায় সপাট তান করছিলো। সা রে গা মা পা ধা নি সা রে গা মা পা মা গা রে সা নি ধা পা মা গা রে সা...
অর্পিতা দি কূটতান ধরে নিচ্ছিলো সঙ্গে সঙ্গে --গা মা ধা পা মা গা রে সা সা রে সা নি ধা পা মা পা গা মা পা মা গা রে সা।।। রবিবারের সকালে সুর ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। জ্যেঠু তার দিকে তাকিয়ে কী নরম করে ডাকছিলেন-- "মামণি!" ...সে তড়বড় করে গেয়ে উঠছিলো --প্রভু দাতা সবন কো।।। উদয়কাকু গম্ভীরমুখে তবলায় আঙুল রেখে বললেন-- "৭ মাত্রার মুখ। ঠিক ধরেছে তো"।। জ্যেঠু হাসলেন। সে আড়চোখে দেখে নিলো জ্যেঠিমা আজ লর্ড চমচম  প্লেটে সাজিয়ে আনছেন। আশ্বিনমাসের ছেঁড়া মেঘ জানলায় উঁকি দিলো। একটা মিশকালো খঞ্জনা লেজ তুলে থমকে দাঁড়িয়ে আছে গুলঞ্চ গাছের গুঁড়ি বরাবর। পেটের কাছটা সাদা। শুধু কালো কিম্বা শুধুই সাদা কোনও পাখি কি সে দেখেছে কোনওদিন? সুজয়কাকু তারানা ধরলেন-- না দীম দীম তা না দীম দীম তা দীম তা না দেরে দীম; উদয়কাকু আঙুলে গুণে দেখাচ্ছেন ৯ মাত্রার মুখ। অর্পিতাদি তাকালো অরিন্দমদার দিকে? অরিন্দমদা আজও সেই হলুদ পাঞ্জাবি। সে আজ দুই বিনুনী করেছে। সুজয়কাকু তারসপ্তকের সা ছুঁয়ে ফিরে আসতেই সবাই একসঙ্গে "ক্যায়া বাত " বলে উঠলো। তার কি একটু মন কেমন করছে? সে ও পারতো। হারমোনিয়ামের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত সাবলীল চলে যেতো গলা। কিন্তু এখন জ্যেঠু বারণ করেছেন। সে কেবল সা থেকে সা রেওয়াজ করে, মায়ের কড়া পাহারায়। সকালে ভৈরোঁ, সন্ধেয় ইমন।


.
জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"। সে নীল দোপাট্টা সামলে নিলো। জানলায় অঘ্রাণ মাসের কিশোরী রোদ, বাঁকা হয়ে পড়েছে। অরিন্দমদার কোলের কাছে শোয়ানো তানপুরা। আঙুল স্থির। জ্যেঠুর ডিভানে শুয়ে আছে লালচে মেরুন কার্ড। উপরে কেমন প্রজাপতির ডানা ঝাপটানো "শুভ বিবাহ" লেখা। সে জানে। ভিতরে ক্যালিগ্রাফি করে লেখা আছে--সবিনয় নিবেদন,আগামী ১৬ ই অগ্রহায়ণ....
তাদের বাড়িতেও কার্ড দিতে এসেছিলেন অনুপম জ্যেঠু আর সুনীতা জ্যেঠিমা। অর্পিতাদি এসেছিলো। মা খুব উৎসাহ নিয়ে বললো--"ওমা! তুই এসেছিস। কী আনন্দ। দাঁড়া, হারমোনিয়াম বের করি। চলেই তো যাবি। সত্যি দাদা, কোথায় যে পাঠাচ্ছেন মেয়েটাকে"...
অর্পিতাদি তাকে একহাতে বেড় দিয়ে ছিলো। সে টের পাচ্ছিলো কেমন অশক্ত, ঘামে ভেজা হাত। মা হারমোনিয়ামে রিড বাজালো। অর্পিতাদি গাইছে-- নয়না ভরু আঁয়ে নীর পিয়া বিন... সে শুনেছে এটা বহুবার, জ্যেঠুর মুখেও। তিলং ঠুমরি।
"লক্ষ্য করো, খামাজের ধৈবত বাদ দিয়ে পঞ্চম আর গান্ধার এসে তিলং হলো। আর দুই নিষাদ পরপর লাগানো যায়।
এই ঠুমরি খুব বেশি শুনতে পাবে না। খাঁ সাহেবের স্ত্রীর কাছে শুনে শুনে শিখেছিলাম আমরা। তিনি তো বিশেষ প্রকৃতিস্থ ছিলেন না। সময়ে অসময়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেন। একদিন গিয়েছি খাঁ সাহেবের বাড়ি। ঘন্টা দুই পরে প্রোগ্রাম, মহাজাতি সদনে। গিয়ে দেখি হুলুস্থুল। সকাল থেকে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সকলে জেরবার। আমরা বেরিয়ে দেখি ট্রামলাইন পার হয়ে পার্কে বসে আছেন। পাশে গিয়ে বসতে শুনি গুনগুন করে তিলং ঠুমরি গাইছেন। এই গান। বোঝো। বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি আনলাম। খাঁ সাহেব উঠে স্নান টান সেরে ধুতি পাঞ্জাবি পরলেন। ছ -ফিট চেহারা। আমরা ভাবছি এই অবস্থায় গাইবেন কী! সারাটা রাস্তা গাড়িতে কেবল সা বললেন। এক সুর। এক পিচ। এক আওয়াজ। প্রোগ্রামে গিয়ে বসেছেন। হল ভর্তি দর্শক। বাইরে বড়ো বড়ো অ্যামপ্লিফায়ার লাগানো। রাস্তায় চাদর পেতে, পানের ডাবর নিয়ে লোক বসে আছে। গান শুনবে। আমরা তো দুরুদুরু বুকে তানপুরা সাজাচ্ছি। এতটুকু রিহার্সাল নেই। পাঁচ মিনিট কেটে যায়। দশ মিনিট কেটে যায়। সবাই উসখুস করছে। খাঁ সাহেব সা লাগালেন। আহা। জোড়া খরজ আর মন্দ্রসপ্তকে সেই কন্ঠ। সব ভুলে গেলাম। মারোয়া গাইলেন। দুই ঘন্টা। গান শেষ হওয়ার পর মনে হলো অডিটোরিয়ামের খিলানে গম্বুজে সুর লেগে ঝুলে আছে সন্ধের মেঘের মতো। মারোয়ায় সিদ্ধ ছিলেন কি না।"

এই গল্প সে ও শুনেছে। অনুপম জ্যেঠু বাবাকে বললেন-- "মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়িতে তো গাইয়ে মেয়ে বসিয়ে রাখলে চলে না। এম. এ পাশ করলো। এবার আমি আমার দায়িত্ব শেষ করলাম। চাকরিবাকরি করবে না কি আরও পড়বে, সে ওর শ্বশুরবাড়ি বুঝবে। ছেলে এত ভালো, বুঝলে তো-- সিভিল সার্ভিসে আছে। দিল্লীতে গাড়ি, বাংলো। আর কী? অ্যাঁ!!"

বাবা সায় দিচ্ছেন। সে দেখতে পাচ্ছে। অর্পিতাদি চলে যাচ্ছে, তাদের উঠোনে শিউলি গাছ এবারের মতো শেষ ফুল ফুটিয়ে রেখেছে। কার্তিক মাসের নরম ঠান্ডা। গ্রিলের গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। দিদি একবার পিছনে তাকালো-- নয়না ভরু আয়ে নীর পিয়া বিন। তার হাতে নরম চারচৌকো চিরকুট-- দিদির ছোট্ট লেখা। রবিবার। বিকেল ৪ টে। লর্ডসের মোড়।

মা এত জোরে ডাকলো--"তুতুল!" সে কেঁপে উঠলো। হাত থেকে চিরকুট পড়ে গেছে। মা এগিয়ে আসছে-- "কাল ভূগোল পরীক্ষা। লোকজন এলো তো ব্যস। লেজ তুলে বসে পড়লে। যাও। যাও শিগগির....এটা কী, অ্যাঁ?"
মা চিরকুট তুলে নিয়েছে। তার গালে সপাট চড়।

বেহাগের জলদ ত্রিতাল। অন্তরা ছুটে যাচ্ছে। আজ হুঁ না আয়ে সদারঙ্গ পিয়া"।।। গা মা পা নি সা গা রে সা নি রে সা নি ধা পা মা পা সা নি ধা পা মা ধা পা মা গা মা পা নি সা সা। অরিন্দম দা দেখা করলো কি? লর্ডসের মোড়ে? সে তো জানিয়েছিলো। মায়ের সমস্ত বারণ, শাসন, মারধোর উপেক্ষা করে।

কোনও কোনও রবিবার এমনও হতে পারে। যোধপুর পার্কের হলুদ বাড়িতে সুর ভাসছে না। জ্যেঠিমার কপালে গোল লাল টিপ কেমন যেন ধ্যাবড়ানো, মুখে পান নেই। সে গেট খুলে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেল না তানপুরার আওয়াজ। এটা আলাদা তানপুরা। জ্যেঠুর নিজস্ব। খুব নরম সবুজ পোশাকে ঢাকা থাকে। শুধু জ্যেঠু আঙুল রাখেন, বাঁধেন পঞ্চমে বা মধ্যমে। কোনও কোনও দিন অন্যমনস্ক বলেন --"মাস্টারমশাই এই তানপুরায় রেওয়াজ করতেন। গোপাল নস্করের হাতে তৈরি, খাস জিনিস। এত অল্প বয়সে চলে যাবেন, কে ভেবেছিলো! বৌদি এটা আমাকেই নিয়ে আসতে বললেন। আর কে ই বা নিতো! সবই তো বিক্রি করে দিলো দুই ছেলে"...

তারা চুপ করে বসে শুনতো। জ্যেঠুর কোনও গুরুভাই এসেছেন হয়তো সেদিন। একটু পরেই জ্যেঠু বলবেন-- "মামণি! তোমায় পাহাড়ী ঠুমরি শিখিয়েছি, না? ম্যয় ক্যয়সে আউঁ বলমা।। গাও তো। সা লাগাও। সবাই গলা দাও। ছোটো ছোটো আবর্তনে সমে ফেরো। উদয়! ষোলো মাত্রার যৎ। বাঢ়হৎ করে এগোও। শাস্ত্রীয় সংগীতের মতো ঠুমরিতেও বাঢ়হৎ হয়। আমাদের কিরানা ঘরানার এটা বৈশিষ্ট্য। শুধু এক্সটেম্পোর গাইলে মনোটোনাস হয়ে যাবে। মামণি! মুড়কি আরও স্পষ্ট করো। গোল আওয়াজ। ভারি কাজের উপর গাও..."

এই রবিবারটা এত আলাদা। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন্দমদা হাঁটু মুড়ে বসে আছে। কার্পেটের উপর। জ্যেঠুর পায়ের কাছে। পিঠ কাঁপছে। সে দেখতে পাচ্ছে। সেই ময়ূর। রাধাকৃষ্ণ। হলুদ পাঞ্জাবি, পকেটের কাছে অল্প ছেঁড়া। কাপড়ের ব্যাগ পড়ে আছে পাশে।জ্যেঠুর পায়ের উপর মাথা ছুঁয়ে আছে দাদার। জ্যেঠুর হাত দাদার মাথায়; অস্ফুটে কিছু বললেন? সে আবছা শুনতে পেলো-- "সংগীতই তোমার শক্তি। অনুভূতি নানারকম, তার প্রকাশও বিভিন্ন। দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা না পেলে শিল্পী হবে কী করে? না না অরিন্দম। যা হয়েছে, ভালোর জন্যই হয়েছে। তুমি সাধনায় ডুবে যাও বাবা। ইচ্ছা হলে আমার এখানে এসে থাকো। রেওয়াজ করো। ডিসেম্বরে মুম্বইতে তোমার অত বড়ো প্রোগ্রাম। এখন কি ভেঙে পড়লে চলে? তুমি ফিরিয়ে না দিলেও কি তোমরা একত্রে বাস করতে পারতে? সুখী হতে পারতে? সংগীতে ডুবে যাও। সব দুঃখের শেষ আছে, শোকের অন্ত আছে।nসংগীত অশেষ, অনন্ত। সা লাগাও। সা লাগাও।"


.
জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য সে চুপ করে রইলো কি? জ্যেঠুকে এক লহমার জন্য কি  মনে হলো হৃদয়হীন? মাত্র আধঘন্টা আগে সে উঠে এসেছে রাজ্য সংগীত অকাদেমির সাদা কালো দাবার ছক মার্বেল বারান্দা থেকে। তার কি কোনও অসম্ভব আশা ছিলো? প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হলে সে শিখতে পারবে স্বনামধন্য সংগীতশিল্পীদের কাছে-- তাঁরা প্রখ্যাত শিক্ষক, আচার্য। সাংগীতিক প্রতিষ্ঠার অলিগলি তাঁদের নখদর্পণে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন এই ক'দিনে সে বহুবার শুনেছে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের গল্প। কীভাবে তাঁরা মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন এখানে, ওয়ার্কশপ করেছেন নিয়মিত, স্কলারশিপ নিয়ে শিখতে গিয়েছেন গুণীজনদের নিজস্ব এরিনায়। আরও আরও কানাঘুঁষো কিন্তু সে কি নিবিষ্ট হয়ে আরও শিখতে চায় নি? শুধু শিক্ষা? নিবেদিতপ্রাণ চর্চা? রেওয়াজ?
অথচ বাবা পরিষ্কার বলে দিলেন যে তিনি অন্যত্র কোথাও পাঠাবেন না। প্রতিযোগিতার ফলাফল যতই ভালো হোক, গান তার পেশা হতে পারে না। পড়াশুনা নষ্ট হবে, সময়ও আর...
যা কিছু উহ্য থাকলো, সে তা পড়তে পারে ইদানীং। সে দেখেছে তাকে ঘিরে কেমন তৈরি হচ্ছে সতর্ক চোখ, অতন্দ্র পাহারা, অবিশ্বাসের বাতাবরণ। কেউ কি দেখে তাকে? সে কি দেখে কাউকে? লুকিয়ে দেখা হয়? কথা বলে কারো সঙ্গে অথবা নিছকই দৃষ্টিবিনিময়? মঞ্চে গাইতে গেলে মা পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন কঠিন মুখে, মাঝেমধ্যে মারধোর হাওয়ায় ভাসা খবরে, পড়াশুনার জন্য আরও খর চাপ, আরও অসহ প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে রেওয়াজ করে সে একা, একা। সায়ন্তনী, দিতিপ্রিয়াদের হাত ছাড়িয়ে সে একাই হেঁটে যাচ্ছিলো অকাদেমির গেটের দিকে। লাল মোরামের পথ, দুদিকে কেয়ারি করা নরম সবুজের ভিতর ফুটে উঠেছে পপি, নাইন ও ক্লক, জিনিয়া। প্যাস্টেল শেডের দিকে তাকিয়ে তার চোখে জল আসছিলো। এইসব আর্চ, খিলান, থাম তার জন্য নয়। চওড়া মঞ্চ, তানপুরার গভীর আওয়াজ, তবলায় সম পড়লেই তবলিয়ার দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা ঝোঁকানোর মুহূর্ত - সফলতা থেকে তাকে অনেক অনেক দূরে সরে যেতে হবে। জ্যেঠু তাকে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে, কাছেই। বাবার জরুরি কাজ আছে। ফেরার সময় নিয়ে যাবেন।
 জ্যেঠুর বাড়ির জানালার গরাদে একইরকম রোদ, আলো, হাওয়া। একইরকম ছ'তারের তানপুরা। সে শ্রুতি শেখে। পুরিয়া শেখার সময় জানতে পারে সোহিনী আর মারোয়া রাগেও একই স্বরস্থান অথচ চলন পৃথক, ধৈবতের শ্রুতি পৃথক। আবিষ্কারের আনন্দে ভাসতে থাকে সে।
সফলতার পৃথিবী থেকে সরে আসতে থাকে, মঞ্চ থেকে, দর্শক থেকে, শূন্য ঘরে শুধু জ্যেঠুর কন্ঠে ভরে উঠতে থাকে সুর--- সে তীব্র মধ্যম ছুঁয়ে উঠে যায় ধৈবত, সেখান থেকে শুদ্ধ নিষাদ হয়ে তার সপ্তকের কোমল রেখাবে। শ্যামসুন্দর কো সুন্দর মুরতিয়া। পঞ্চম বর্জিত। পঞ্চম-- চিরশুদ্ধ স্বর। তার কড়ি নেই, কোমল নেই, অব্যয়। সেই পঞ্চম নেই এই রাগে। তার জীবন অনির্দিষ্ট। অজস্র উত্থান পতন। তার পঞ্চম থাকবে না?

জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"। সে কি বলবে জ্যেঠুকে এই সপ্তাহে তার একেবারেই রেওয়াজ হয় নি? এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় তার ফলাফল আশানুরূপ হয় নি। মা ক্রুদ্ধ, বাবা ক্ষুব্ধ। স্কুলের ফার্স্ট গার্লের তকমা তাকে ছেড়ে গেছে। জানলায় আজ মৃদু ঘোলাটে বিকেল। গুলঞ্চ গাছে কাকের বাসা; কবে হলো? বাসায় ফেরার পর কর্কশ ডাকছে। সে উঠে জানালা বন্ধ করে দিলো। নীলাঞ্জনা খুব মন দিয়ে নোটেশন লিখছে। রাগ --শ্যামকল্যাণ। নি সা রে মা পা মা পা গা মা রা নি সা। আরোহণে কড়ি মধ্যম, অবরোহণে শুদ্ধ মধ্যম। সে একটু অবাক হয়। জ্যেঠুর কাছে তারা কোনও দিন স্বরলিপি লেখে নি। ইদানীং অনেকে শিখতে আসে-- দামী গাড়ি, দামী ঘড়ি, মোটা চামড়ায় মোড়া ডায়েরি। খুব মন দিয়ে টুকতে থাকে ভাতেখন্ডের বই থেকে। আরোহণ, অবরোহন, পকড়, বিলম্বিত একতাল, জলদ ত্রিতাল। এক রাগ শিখতে একমাসও সময় নেয় না। জ্যেঠুর কাছে এসে অভিভাবকরা ই বলেন একটু ইমনকল্যাণ টা দেখিয়ে দেবেন গুরুজী। অথবা শিবরঞ্জনী। অথবা মালকোশ। এইসব রাগে অনেক ফিল্মি গান। এদের মধ্যে কেউ কেউ কিছুদিন পর মঞ্চে, টিভিতে গাইতে চলে যায়। রিয়্যালিটি শো। সে বুঝতে পারে জ্যেঠু ক্লান্ত। সংগীত নিজের চেহারা পাল্টে ফেলছে-- জ্যেঠু প্রাণপণে লড়াই করতে থাকেন। শুধু রবিবার সকালটা রেখে দেন তিন - চারটি প্রিয় ছাত্রছাত্রীর জন্য--- যারা নোটেশন, পরীক্ষা কিছুই চায় না। শুধু ঘরময় সুরের পাখি উড়ে বেড়ায়, ঘুলঘুলিতে বসে, কার্পেটে এসে থমকে দাঁড়ায়--- তারা সুর ছিটিয়ে দেয় হাওয়ায় হাওয়ায়, তুড়ুক পায়ে সে উড়ে গিয়ে বসে জানলার পৈঠায়। তারপর কখন যেন ঘর থেকে বেরিয়ে গুলঞ্চ গাছে বসে দোল খায়। জ্যেঠু আঙুল চালান সবুজ পোশাকের তানপুরায়, সে আঙুল চালায় ছয়তারের মেহগনি রঙ শরীরে-- তার গালের উপর ছায়া ফেলে সুর, চুলের গুচ্ছ ফর্সা কপালে লুটিয়ে থাকে। ঠোঁট কাঁপতে থাকে সরগমে-- নি রে গা মা ধা মা ধা মা গা--,রৈন কা স্বপনারি  ম্যয় কৈসে কহুঁ তোসে।। আর তার পাতলা রোগা শরীর কাঁপতে থাকে ভয়ে-- যদি সে পিছিয়ে পড়ে স্কুলে, পড়াশুনায়, প্রতিযোগিতায়!

.
জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"। ডক্টর স্বপন হালদার বললেন --"ডিসেকশন রুমে রুমাল ব্যবহার করবে না কেউ।" জ্যেঠু বললেন--"মধুমন্তী দিবা তৃতীয় প্রহরের রাগ। আরোহণে 'রে' আর 'ধা' বর্জিত।কোমল গান্ধার, কোমল নিষাদ, তীব্র মধ্যম।"

ডক্টর আই সেন স্পষ্ট তার নাম ধরে ডাকলেন--"ত্রিধা! বার্ডস আই ভিউ দিয়ে কিন্তু হেড নেক অ্যানাটমি বোঝা যাবে না। হাতে নাও, ভিসেরা হাতে নাও। গ্লাভস কোথায় তোমার? স্ক্যালপেল?" সে দেখছে বেলা পড়ে আসছে। তার এখনও হেড-নেক স্টাডি করা হয় নি। এরপর লাংস আছে, হার্ট। আজ বিকেল ৪ টের মধ্যে জ্যেঠুর বাড়ি পৌঁছানো হবে না। কিছুতেই নয়। ফর্মালিনের তীব্র গন্ধ, বিশাল বড়ো চৌবাচ্চা থেকে পা ধরে হিড়হিড় করে বডি তুলে আনে ডোম রা। শক্ত কাঠ শরীর, পাঁপড়ের মতো চামড়া, নগ্ন--শুইয়ে দেয় মার্বেল টপ টেবিলে। ঝাঁকে ঝাঁকে টিউবলাইট, মসৃণ সাদা আলো-- সাদা অ্যাপ্রোন, অফ হোয়াইট গ্লাভসে টেবিল ঘিরে দাঁড়ায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা। আহা! এদের হাতে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জীবন-মরণ।
জ্যেঠু বললেন --"সা লাগাও।" অবরোহণে রেখাবে ন্যাস করবে। কাঁহে মান করো সখীরি অব"--- ১০মাত্রার মুখ থেকে স্থায়ী। ডক্টর এম রায় ক্লাসে  ঢুকে গম্ভীর গলায় বললেন-- "রোল নম্বর থার্টি সেভেন! কে!" সে ঢুলছিলো। পাশ থেকে সংহিতা আঙুল দিয়ে খোঁচালো-- "তোকে ডাকছে। ওঠ।" সে অন্যমনস্ক উঠে দাঁড়ালো। কাল সারারাত রবীন্দ্রসদনে প্রোগ্রাম দেখেছে। উস্তাদ রশিদ খাঁ।।। ভোররাতে ধরলেন মিঞা কী টোড়ি। আহা পঞ্চমে দাঁড়াচ্ছেন, যেন ভোরের আলোয় জেগে উঠছে শরীর, খুলে যাচ্ছে পদ্মকোরক চোখ-- কে ডাকছে তাকে! দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন নবীন সন্ন্যাসী। নবী আলি কো নূর ভর রাহো। খালি পা, মুণ্ডিতমস্তক, কে কাকে ভিক্ষা দেয়-- কিরবানিতে ধরলেন ব্রিজ কী নন্দলালা, তোহে বিনা মোরি চ্যান নাহি।। নাহি, নাহি রে। চ্যান নাহি। কতদিন সে যায় নি জ্যেঠুর বাড়ি, কতদিন ভোরের রেওয়াজ হয় নি তার।
"রোল নাম্বার থার্টি সেভেন! ইউ! ক্লাসে এত ইনয়্যাটেন্টিভ কেন? আগের পরীক্ষায় ওইভাবে অনার্স মিস করলে মেটেরিয়ায়। এবার একটু সিরিয়াসলি পড়ো। ইউ হ্যাভ দ্য পোটেনশিয়ালস। নষ্ট করছো, নষ্ট করছো সব।"

জ্যেঠু বললেন --"সা লাগাও"।। সে দেখছে তার কামিজের কোণায় লেগে আছে শুকনো কফের দাগ। ক্লিনিক্যাল ক্লাসে লেগেছিলো কি? জ্যেঠু বললেন-- "মামণি, দমের ঘাটতি হচ্ছে কেন মা? সকালে অন্তত ১৫ মিনিট বসো তানপুরা নিয়ে। সুরটা ছাড়ো, আওয়াজটা। দম হলো ক্লাসিক্যাল গানের জান। তানের মাঝখানে ছেড়ে যাচ্ছে সুর, তোমার লয় তো কখনও এত নড়ে যেতো না।" সে মাথা নীচু করে আছে। সকাল ৬ টায় বেরোতে হয়। বেহালা থেকে দমদম। মেডিসিন প্রাইভেট টিউশন। নিতেই হবে। আরও আরও কেস স্টাডি। আরও হসপিটাল, আরও ক্লিনিক্যাল। জ্যেঠুর কাছে ক্লাসের মাঝখানে সে এসে ঢোকে। হা-ক্লান্ত। সারাদিন রুগী আর বইপত্র ঘেঁটে স্নান না করে কিছু খেতে ইচ্ছা করে না তার। শিঞ্জিনী ইতিহাসে অনার্স নিয়ে যাদবপুরে ভর্তি হয়েছে। তণ্বী ম্যাথস অনার্স। নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শেষ হয়। একটা ঘর থেকে অন্য ঘরে।নির্দিষ্ট সময়ে লাইব্রেরি। সে আবর্তনে গুলিয়ে ফেলে। তণ্বী তাড়াতাড়ি সম ধরে নেয়-- আয়ে, দামিনী দমকে, বরষা ঋতু-- চমকে বুন্দন, বরষে মেহ আও, নেহি আওয়ে পিয়ারাবা।। সে ক্রমশ চুপ করে যায়। অন্যমনস্ক তানপুরা ছাড়ে। ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট বেরোয়। অনসূয়া ফার্স্ট। সে কলেজে সেকেন্ড। লেবার রুমে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকে-- গুমগুমে এ সি ভেদ করে শুনতে পায় মেঘ ডাকছে কলকাতার আকাশে। বৃষ্টি নামল। দাদুরা মোরহা, পাপিহা বোলে। মুঝে বিরহন কো জিয়ারা ডোলে। ক্যায়সে আয়ে প্রীত সন্দেশবা--- 



ক্যায়সে আয়ে। কী করে আসবে সে? জাতি-- ঔড়ব ঔড়ব। মেঘমলহার। তাদের ঘরানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উস্তাদজীর কিংবদন্তি বন্দিশ। কাদের ঘরানা? ঘরানা মানে কী? ঘর? কোথায় তার ঘর? সে কোমর জলে হাঁটতে থাকে মৌলালীর দিকে। আজ মেজপিসির বাড়ি রাত কাটাতে হবে। পৌঁছানো হবে না ঘরে, নিজস্ব ঘরানায়। বৃষ্টির জলে মিশে যেতে থাকে অতীতের ভারি মেঘ। হায়ার সেকেন্ডারির পর বাবা কিছুতেই প্রেসিডেন্সির বাংলা অনার্সের ফর্ম তুলতে দিলেন না। দাদাভাই নিরাশ হয়ে ফিরে এলো। তার মতামত মূল্যহীন। সে আর মতামত দেয় না। ভয় তাকে আষ্টেপৃষ্টে চেপে ধরে আছে। বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। উত্তেজনা ভালো নয়। মা যদি আবার সেই আগের মতো নার্ভের অসুখে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে? তার দায়িত্ব নেই এদের ভালো রাখার? সবাইকে ভালো রাখার? দাদাভাই ইঞ্জিনিয়ারিং হস্টেলে, দূরে। সে যা কিছু শিক্ষাদীক্ষা পেয়েছে, গানের রূপ রস গন্ধ, সুরের সহবাস-- মা বাবা দাদা না থাকলে পেতো কি? সে তো সত্যি কিছু বোঝে না। হায়ার সেকেন্ডারি সায়েন্স নিতে তার কী ভয়। সে ভেবেছিলো পাস করতে পারবে না, অংকে আর ফিজিক্সে নির্ঘাৎ ফেইল করবে। কী করে স্টার মার্ক্স পেলো? লেটার? আর কে বিশ্বাস করবে তাকে? 



বাস বন্ধ হয়ে গেছে কলেজ স্ট্রিটে, সুকিয়া স্ট্রিটে বুকজলে নৌকা চলছে। মা বললেন-- "ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল। তাহলে বিয়েটা ফাইনাল ইয়ারের পর হোক। বাবুর পক্ষে বছর দুই আগে তো আবার দেশে আসা সম্ভব নয়। এই তো ঘুরে গেলো.."




বাবা কিছুই বললেন না। সে মুখ নীচু করে আছে। তার মালকোশের বিলম্বিত একতালের অন্তরা শেখা বাকি। একমাস হয়ে গেছে, স্থায়ীটুকু শেখার পর সে জ্যেঠুর কাছে যায় নি আর। পরীক্ষা দিচ্ছিলো। পরীক্ষা দিচ্ছে সে। অনন্ত, অসীম পরীক্ষা।  
.
জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"।। 



সে হাতের ঘড়ির দিকে চট করে একবার তাকিয়ে নিলো। সন্ধে ৬ টার ব্যারাকপুর লোকাল ধরতে পারবে কি? শিয়ালদহ অবধি বাস। তারপর পয়দল মিনিট দুই। শ্বশুর শাশুড়ী রাজস্থান বেড়াতে গেছেন তার বিয়ের মাস তিনেকের মাথায়। তার ইন্টার্নশিপের শিফট ডিউটি চলছে। ১৫ দিন মর্নিং, ১৫ দিন ইভনিং। বিয়ের সময় বাবা অকুন্ঠ বলেছিলেন-- "সাংসারিক কাজ কিছুই জানে না। পড়াশুনা আর গান ছাড়া কিছু তো করেনি"। এই অপরাধে বিয়ে আটকায় নি। সে কি তেমন বাধা দিয়েছিলো? এই অপছন্দের পড়া তার আর টানতে ইচ্ছা করছিলো না। সে ভেবেছিলো শূন্য থেকে শুরু করবে? এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে? সে কি বিশ্বাস করেছিলো ভালোবাসায়? বন্ধুত্বে?
তার কাঠের তানপুরা একটেরে পড়ে আছে। সে হাতে ঘড়ি পরে মশলা বাঁটছে শিলে। স্বামীর লাঞ্চবক্স গুছিয়ে সে সকাল ছটা পঞ্চাশের ট্রেন ধরবে। আজ তার ইন্টার্নশিপের লাস্ট দিন। সহপাঠীরা অনেকেই এম ডি এন্ট্রান্স পার হয়ে গিয়েছে। সে দেয় নি এ বছর পরীক্ষা। আগামী বছর দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে মনে মনে। সে বুঝতে পারছে জীবন তার স্বেচ্ছাধীন নয়।
 শাওয়ারের তলায় অকপট ভিজতে ভিজতে সে শুনতে পায়-- "সা লাগাও। প্রতিটি রাগ এক একটি পৃথক দর্শন। ফিলোসফি। স্বরস্থান অনুযায়ী অলংকার। শুক্তোর মশলা দিয়ে মাংস হবে না। মামণি! রাগেশ্রী আর বাগেশ্রী তে মূলত গান্ধারের পার্থক্য কিন্তু চলন ও ভাব সম্পূর্ণ পৃথক। একটি বিরহ, অন্যটি শৃঙ্গার। সে জানে না শৃঙ্গার কেমন। তার স্বামী অফিসফেরত কানে ফোন নিয়ে বাড়ি ঢোকেন। তারপর কম্প্যুটার, গেম কতরকম। মাঝেমধ্যে বন্ধুরা আসে। সে বই পড়ে, গান গায় আপনমনে। জ্যেঠুর কাছে যাওয়ার কথা কেউ বলে না। ব্যারাকপুর থেকে যোধপুর পার্ক--দুই পৃথিবী যেন। জ্যেঠু ফোন করেন প্রায়ই। "সা লাগাও। ভোরবেলা শুধু সা থেকে পা। মন্দ্র আর মধ্য সপ্তকে। "সে জিজ্ঞাসা করে "আভোগী কানাড়ায় রেখাব আর কোমল গান্ধার পরপর লাগবে? সে গেয়ে শোনায় চরণ ধর আয়ো.." গাইতে গাইতে দম ফুরিয়ে যায়। মধ্যরাতে তার ক্লান্ত, অবসন্ন, অপ্রস্তুত শরীর বন্য স্বাদ পায়। ভোরবেলা টলতে টলতে উঠে সে শুনতে পায়--"এত বেলা হলো। এখনও চা করো নি ত্রিধা! আশ্চর্য!! "কেউ তাকে ভোরবেলা রেওয়াজ করতে জোর করে না। শুধু আত্মীয়স্বজন এলে হারমোনিয়াম বেরোয়। গাঢ় বাদামী, ভারি কাঠের স্কেল চেঞ্জার। জ্যেঠু দিয়েছিলেন, বিয়ের উপহারে। 



জ্যেঠু বললেন--" সা লাগাও"। সে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে, লেভেল ক্রসিং এর গেট নেমে আসছে। আজও তার চেম্বার বন্ধ করতে আটটা দশ। তার আয়ামাসী আটটায় ফিরে যাবে। তারপর টুঁই কার কাছে থাকবে? অরিত্রের বিদেশবাস ২ বছর হলো। টুঁই তখন তিনমাসের ছিলো। এখন প্রায় আড়াই। জ্যেঠু বললেন--"মামণি। দিদিভাই কে গান শিখিয়ো।" সে ব্যাগ হাতড়ে দেখলো দুটি একটাকার কয়েন পড়ে আছে। হাউসস্টাফশিপের সুযোগ  ছেড়ে দিতে হয়েছিলো, টুঁই তখন দুই মাসের। পরের মাসে অরিত্র চলে গেলো আমেরিকা, সব পেয়েছির দেশ। সে তখনও ভরসা করে আছে নিজের দায়িত্ববোধের উপর। এতগুলো মানুষ দুটি পরিবারে, ছোট্ট সন্তান-- লড়াই। সে ট্রেন ধরে দুটি স্টেশন পার হয়ে চেম্বার করতে আসে-- ট্রেনের চাকায় ভীমপলাশির সরগম- যমুনা কি তীর, বংশী বাজাবত। নি পা গা মা পা গা মা নি পা গা মা রে সা। কিন্তু সময়ের ঠিক থাকে না। আয়ামাসী ফিরে যায়। টুঁই কাঁদে। শাশুড়ী মা বিরক্ত কন্ঠে ফোন করেন। একেই বংশে পুত্রসন্তান নেই। নিজের আদরের ছেলেটি বিদেশে। তাঁর সংসার অসহ্য লাগে। তিনি বেড়াতে যান দূরে, সে কন্যা নিয়ে বাপের বাড়ি যায়।
জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"।। ললিতের গান্ধার আর ধৈবত কে জুড়ে রেখেছে দুই মধ্যম। পঞ্চমের পুকার এই রাগে নেই তাই। গলা লাগাও। রৈন কা স্বপনারি ম্যয় কৈসে কহুঁরি। গা মা ধা মা ধা মা মা-- দুই মধ্যম পরপর। 



এক রবিবার সকালে সে একা একা যোধপুর পার্কের হলুদ বাড়ির গ্রিলের গেট খুলে ভিতরে ঢোকে। সুর ছড়িয়ে আছে মাঘের কুয়াশামাখা সকালে। সে জানলার ধারে পা মুড়ে বসে আর শুনতে পায় অস্ফুট সব শব্দ-- "দিদিভাইকে আনলে না!"
"তোমার কথা গুরুজী প্রায়ই বলেন আমাদের। তোমার ঠুমরি শুনে নাকি ডোভার লেন মিউজিক কম্পিটিশনে জাজরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, মাত্র ষোলো বছর বয়স...সত্যি?"
কার্পেট বদলে গেছে। নীল লেকের জল, ধারে ঘন সবুজ ঘাস আর অজস্র রঙিন ফুল। সে এসব ছবি দেখেছে। অরিত্র পাঠায়। চওড়া রাস্তা, ঝকঝকে, অমলিন, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গর্জন ছবি ভেদ করে শুনতে পায় সে--"এত অভিযোগ কেন তোমার? মা কিছু এমন বলেন না যে তোমার গায়ে ফোস্কা পড়ে। আয়া আছে, কী কাজ তোমার? ওদের সঙ্গে থেকে থেকে ওদের মতো ঝগড়াটে স্বভাব হচ্ছে তোমার... কিস্যু হবে না তোমার, কোনও দিন কিস্যু করতে পারবে না। শুধু অভিযোগ আর অসন্তোষ..."
জ্যেঠু বললেন--"শমীককে চেনো তুমি মামণি? বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী স্মরণ ভট্টাচার্যের নাতি। উদয় তো ছেলের কাছে ব্যাঙ্গালোরে, এখন শমীক রবিবারের ক্লাসটায় আসে সঙ্গতের জন্য।
সে মুখ ফিরিয়ে দেখলো উজ্জ্বল যুবক। ফর্সা দোহারা। একমুখ হাসি। হাতজোড় করে নমস্কার করছে। বহু দূর থেকে সে শুনতে পায়-- "আপনাকে আমি চিনি। রাজ্য সংগীত অকাদেমি তে আপনি যে বছর সব বিষয়ে প্লেস পেলেন, সেইবছর আমি তবলা লহরায় সেকেন্ড হয়েছিলাম। তারপর কোথায় যে আপনি হারিয়ে গেলেন! এখন কার কাছে তালিম নিচ্ছেন.." 



জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও।" তার কেমন যেন ভাঙা ভাঙা কন্ঠ। মন্দ্রসপ্তকের চড়ার সা থেকে সুর সরে যাচ্ছে। দ্রুত ত্রিতাল মনে পড়ছে না তার। "যোগিয়া মোরে ঘর আয়ি..." তারপর? তার নোটেশন নেই। কিচ্ছু নেই। সমস্ত সুর, তাল, লয় আঙুলের ফাঁক গলে ঝরে পড়ছে কার্পেটের উপর। সকলে কুড়িয়ে নিচ্ছে, সাজিয়ে নিচ্ছে গলায়। সে ছুটে পালাতে লাগলো। বারান্দা ভর্তি রোদে বসে টুঁই দুলে দুলে রাইম বলছে-- ওয়ান টু, বাকল মাই শ্যু... বাবা খুব করুণ হাতে তার দিকে ফর্ম এগিয়ে দিচ্ছেন। প্রাইমারি শিক্ষকের পরীক্ষা হবে রাজ্য জুড়ে। তার জেনারেল স্ট্রিমের পড়াশুনা নেই। সেকেন্ডারি স্কুলে পড়ানোর যোগ্যতাও নেই তার। হায়ার সেকেন্ডারির পর এতগুলো বছর মুছে যাচ্ছে তার জীবন থেকে।
জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"...সে চেম্বার বন্ধ করলো। সমস্ত নতুন করে শুরু করতে হবে? কোথায় পাবে বই? জ্যেঠু বললেন--"মালকোশের কোমল নিষাদের পরিবর্তে শুদ্ধ নিষাদ লাগলে চন্দ্রকোশ হয়"।। আজও আটটা পনেরো। লেভেল ক্রসিং বন্ধ হয়ে গেছে। সে নিচু হয়ে কাঠের ব্যারিকেড পার হলো। অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে কিছু? গ্যালোপিং ট্রেন? থ্রু ট্রেন? ডলিমাসী চলে গেলে টুঁই কার কাছে থাকবে? মা সিরিয়াল দেখবেন। বিরক্ত হতে পারেন। এর মধ্যে একদিন কলেজ স্ট্রিট যেতে হবে? সরকারি চাকরির প্রস্তুতি, বইপত্র... খুব জোরালো আলো... জলদ  ত্রিতাল... মধ্যসপ্তকের সা থেকে সে ধরলো, "আজ মোরে ঘর আইল বলমা, করুঙ্গী অদা রঙ্গ সে রঙ্গরলিয়া"... তবলার বাঁয়াতে ধা পড়লো, আকাশে সাদা পাথরের থালার মতো ঠান্ডা চাঁদ। আলো আর তিনতালে মিশে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে সে বুঝতে পারলো একটি কালো অবয়ব তাকে টেনে নিলো। কানের পাশ দিয়ে বেজে যাচ্ছে তিনতাল, ষোলো মাত্রা। সে অন্য কিছু শুনতে পাচ্ছে। এই আওয়াজ তার চেনা, স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে বহুবার শুনেছে, মানুষের হৃদপিণ্ডের লাবডুব। তার মুখ ডুবে আছে মানুষের বুকের ভিতর।

 .
জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"। 



সে শুনলো--"মরতে চান নাকি?"
জ্যেঠু বললো--"ভৈরবীর মজা হচ্ছে তুমি যেকোনো ক্রস নোটে গিয়ে ফিরে আসতে পারো"
সে বললো--"না তো!আমি আসলে বড্ড তাড়াহুড়ো করছিলাম।মানে অন্যমনস্ক,মানে...আপনি কোথা থেকে এলেন?
"যখন ওইভাবে রিস্ক নিয়ে লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছেন, তখনই বুঝতে পেরেছি মাথায় গণ্ডগোল। বাড়ি কোথায়? কোনদিকে যাবেন?"
জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও। বাবুল মোরা নৈহার ছুটন যায়ে।।। দেখো ঠুমরি হলো বিশুদ্ধ প্রেমসঙ্গীত। মানবপ্রেম। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাব বলতেন যে খেয়ালের চেয়ে ঠুমরি গাওয়া কোনও অংশে সহজ নয়। ভগবৎপ্রেম হলেই সেটা ভজন হয়ে যাবে। মানুষ চিরকাল এই দ্বন্দ্বে থাকবে। কতটা প্রেম, কতটা পূজা। 



সে বহুবছর পরে তানপুরার ঢাকনা খোলে। হলুদ ঢাকা। কানগুলি আস্তে আস্তে চেপে ধরে সুর বাঁধে। তাকে গাইতে হবে। নীল ইনল্যান্ড লেটার আসে স্কুলের ঠিকানায়। মাসে, দু-মাসে একবার। সে ফোনে শুধু গান রেকর্ড করে পাঠায়। সপ্তাহে, দু -সপ্তাহে একদিন। যেদিন ইচ্ছা হয়। যেদিন গাইতে গাইতে দু-চোখে ভেসে ওঠে রোগা কালো দোহারা চেহারা, বাঁ হাতের কবজিতে ঢলঢলে অনভ্যস্ত ঘড়ি, তার ওষুধের বাক্সে লেগে সেই ঘড়ির ডায়ালে চিড়। ঝমঝম করে ট্রেন চলে যায় দামোদর - কাঁসাই নদী পার হয়ে। সে ভাবে এ কী সম্ভব! এত ভালো ছাত্র, এমন উজ্জ্বল কেরিয়ার--- শুধু রুক্ষ পাথুরে জমিতে ফসল ফলাবে বলে থেকে গেলো গ্রামে! গরীব ছাত্রদের পড়ানো চলে সন্ধেবেলায়। বিনিময়ে কখনো সখনো লাউটা, বেলে মাছটা। রান্না করে সেইসব ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ভাগ করে খাওয়া। 



জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"।। সে শুনলো--"বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনেছেন? সেখানে পড়াশোনা করেছি। চাষ করবো না তো কি!"
সে বিস্মিত হয়ে শুনতে থাকে নিজের কন্ঠ--"চার কাহার মিলি ডুলিয়া মগাঁও"।। জ্যেঠু বললেন-- আহা। গাও মা। স্পেস নিয়ে গাও। ক্যায়াবাত বহু শোনা যায় জীবনে মামণি, আহা শোনা যায় এক - দুবার"... 



সে রেওয়াজ করে সন্ধেবেলা, তিলক কামোদ-- নীর ভরন ক্যয়সে যাউঁ সখি অব।। টুঁই ছোটো ছোটো হাতে নির্ভুল তাল রাখে। সে শেখাতে থাকে-- রে পা মা গা সা রে গা সা নি পা নি সা রে পা মা গা সা রে গা--- 



মা এসে চুপ করে বসে থাকেন মোড়ায় রক্তকরবী গাছের ডাল কাঁপে কামিনী ফুলের গন্ধ ছুটে আসে জানলায় বাবা টুঁইয়ের স্কুলের খাতায় যত্ন করে মলাট দেন
অনেক রাতে সে ছোট্ট অডিও রেকর্ড পাঠায় ফোনে--"ম্যয় পনঘট নাহি যাউঁ.." খাম্বাজ
দুই ছত্র কবিতা পায় বিনিময়ে--
"এমনিতে সেই নিঃস্ব কাফের
হাতের রেখাও, প্রবল শীতে
সমস্ত তাপ বিলিয়ে দিতে
একটিবারও আর কাঁপে না 



ভাঁটার জলে নোংরা ফ্যানা




আসর জমায় কথার ফাঁকে!
ঘুণাক্ষরেও তার সেটাকে
বিপজ্জনক হয়নি মনে। 



সে তো ঢেউয়ের শব্দ শোনে, 



বুঝতে পারে ঢেউয়ের প্রকার।
হিসাবনিকাশ, লেখাজোকা
চেষ্টা করেও বুঝলো না সে।" 



চিঠিতে অবশ্য কেজো কথা লেখা থাকে। এবারে বৃষ্টি কম। চাষ আবাদ কেমন হবে জানা নেই। তবু তিনটি মানুষ, যেভাবেই হোক চলে যাবে... টুঁই কি যোগ বিয়োগ শিখলো? আর সকালে কি আধঘন্টা সময় নিজের জন্য বের করা যায় না? রেওয়াজের জন্য? এগুলো নিছক ফাঁকিবাজি... 



সে অফ পিরিয়ডে পড়ে। একবার, দু-বার। ভাঁজে ভাঁজে মুড়ে রাখে বিয়ের গয়নার বাক্সে, আখরোট কাঠের বাক্স, তার ঠাকুমার। ফুল লতা পাতা খোদাই করা। গয়না সব ব্যাঙ্কে, এখন চিঠিগুলো গুছিয়ে রাখে সে। টুঁই বড়ো হয়ে পড়বে কি? 



জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও।" 



টুঁই বললো.."মা আমরা কোথায় যাচ্ছি?"
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির ব্যাক সিটে বসে হেড রেস্টে মাথা রেখেছে সে। একটু অন্যমনস্ক ছিলো কি? অরিত্র বারবার বলছে ট্রান্সফার নিতে, দেশে ফিরেছে বছর দুয়েক হলো, এবার  সংসার করতে চায়। শ্বশুরমশাইয়ের এক্স রে রিপোর্ট নিতে হবে ফেরার পথে। মায়ের জন্য প্রেশারের ওষুধ। এবার কি ফিরে যেতে হবে তাকে? কাল ইস্কুলে চিঠি এসেছে-- ভয় পাচ্ছো কেন? তোমার চারপাশে সুরের বলয়। সেই তো আগুন, সেই তো চন্দন। নতুন তানপুরা নিয়ে যেও। সকাল সন্ধে সুরের কাছে বোসো। যত ব্যথা, যত দ্বিধা, যা কিছু অভিমান-- সুরে সুরে আমায় পাঠিয়ো। এ বছর স্বর্ণশালী ধান ফলানোর চেষ্টায় আছি। বীজ এনেছি। বর্ষা ডেকে এনো তুমি সুরদাসী মলহারে...
সে আস্তে আস্তে টুঁইয়ের মাথায় হাত রাখলো-- "গানদাদুর বাড়ি যাচ্ছি"।
"আমি গান শিখবো, মা! কী গান?"
"সা বলতে শিখবে"
"আমি তো সা রে গা মা পারি"
"আবার বলতে হবে। বারবার বলতে হবে। সাত সুর আলাদা করে, রামধনুর মতো। সাত সুর মিলিয়ে মিশিয়ে সাদা আলোর মতো।"
"গানদাদুর কাছে সুরের রঙ আছে?"
"আলোও আছে" 



জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও।" জানলার পৈঠায় বসে আছে সে। তার বড়োসড়ো গোলাপি ফ্রক, সিল্কের, তাতে সাদা লেসের ফ্রিল। কার্পেটে নীল নদীর অববাহিকায় বসে আছে মধ্যবয়স। ধনেখালি শাড়ি হলুদ রঙের, সবুজ লেবুরং পাড়। পা মুড়ে বসেছে। হাতে মেহগনি রং গম্ভীর তানপুরা। ছয় তার। জ্যেঠু বললেন--"সা লাগাও"। রাগ-দেশ। মামণি! মনে আছে তো? পকড় ধরো। রিনরিনে কন্ঠ। ফর্সা কপালে একমুঠো চুল, টানা টানা চোখে পৃথিবীর বিস্ময়। এবার সে রং দেখতে পাবে সাত সুরে। সে বললো--"সা"। 



জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে আষাঢ়ের যক্ষহৃদয় মেঘ। কত দূরে পাহাড়ের ঢালে একফসলি রুক্ষ জমিতে কেউ ছড়িয়ে দিলো একমুঠো বীজ। বৃষ্টির জন্য চোখ তুলে তাকালো আবার। ফসল যে কত রকমের, সে জানে। আর অন্যজন জানে সাতটি সুরের ভিতর কত শ্রুতি, কত জন্ম, কত মৃত্যু, পুনর্জন্ম।

"বাদরা,লে যা রে সন্দেশ--




কবিতা -ঋণ----সৌরভ বটব্যাল ।।এই গল্পের কোনও চরিত্রের সঙ্গে বাস্তব কোনও চরিত্রের মিল নেই

 






শ্রাবণী খাঁ

মুন্সিয়ারি-খালিয়া টপ ভ্রমণ , হুড খোলা পাহাড়ের দেশে         

যাবার আগের দিন অবধি বুঝতে পারছিলাম না যাওয়াটা আদৌ হবে কী না! টেলিভিশনে চাকরি করা ইস্তক কাউকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি। পাহাড়-কে দেওয়া কথাও কি রাখা হবে? টিকিট গুলো খুলে খুলে দেখি আর বিবর্ণ মুখে বসে থাকি। তারপর হঠাৎ নতুন একটা শুটিং ক্যন্সেল হয়ে গেল দুম করে আর আমার ছুটিটা স্যাংশন হয়ে গেল। লাফিয়ে উঠে বর্ণিনী-দির (কলিগ কম, বন্ধু্ বেশি) হাতে তালি দিয়ে গাইতে শুরু করলাম... কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে, ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা...
তারপর এল ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ফ্লাইটে উঠে পড়ার দিন। কলকাতা থেকে দিল্লীর ফ্লাইট। নভেম্বর মাস। বেশ কনকনে ঠান্ডা। দিল্লী পৌঁছে উবার পেতে কালঘাম ছুটে গেল। রাতটা দিল্লীর একটা হোটেলে কাটিয়ে ভোর ভোর নিউ দিল্লী স্টেশনে চলে এলাম। ট্রেনে দুলুনিতেও ঘুম এলো না। অতিরিক্ত ক্লান্তি, নাকি  উত্তেজনা  জানি না। অবশেষে শতাব্দী এক্সপ্রেস ঢুকলো সবুজ পাহাড় ঘেরা মিষ্টি স্টেশন কাঠগোদামে। নেমেই মনটা ভালো হয়ে গেল। আমাদের ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল স্টেশনেই। গাড়িতে লাগেজ-টাগেজ তুলে দিয়ে শুরু হয়ে গেল পাহাড়ি পথে হুহু করে এগিয়ে চলা।  ড্রাইভার বলল... ‘কল বারিশ হুয়া হ্যা, ঠন্ড বড়েগা, কিসমত আচ্ছা​ হো তো স্নো ফল মিল যায়েগা আপ লোগো কো।’



ছবিঃ কাঠগোদাম স্টেশন

আমরা যাবো উত্তরাখন্ডের বুকে ছোট্ট স্বর্গ মুন্সিয়ারিতে। বরফের রাজ্য। উচ্চতা ৭২০০ ফুট। গত একমাস ধরে শুধুই ইন্টারনেট ঘেঁটে মুন্সিয়ারির ছবি দেখেছি। কিন্তু মুন্সিয়ারি বহু বহু দূর। আমাদের রাতটা কাটাতে হবে আলমোড়ায়। গাড়ি ছুটছে। খানিক দূর যেতে না যেতেই রাস্তা মোহময়ী হয়ে উঠলো। দুপাশে পাইনের জঙ্গল, আকাশের দিকে মুখ তুলে দেওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী গাছ আর বুনো গন্ধ। মাঝে একটা জায়গায় নেমে একটু খাওয়াদাওয়া। তারপর আবার ছুট।      

              
ছবিঃ আলমোড়া যাবার পথে দুপুরের খাওয়া দাওয়া

আলমোড়া পৌঁছোতে পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেল। আলমোড়া টি আর এইচ। অসম্ভব সুন্দর কাঠের ছিমছাম, পরিপাটি ঘর। বিশাল বড় বড় দুটো জানলা। জানলার সামনে সোফা। চারপাশে গাঢ় প্রশান্তি! সন্ধে নামছে। হিমালয় ছুঁয়ে আসা আলো ওক-পাইনের জঙ্গল পেরিয়ে অকৃপণ এসে পড়ছে সমস্ত ঘরে। নানা রকম পাখি ডাকছে, ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, আর আমার মনে হচ্ছে...এই আলো, এই অলৌকিক আলোয় আমার সমস্ত অসুখ সেরে যাবে। ​Heal me, Heal me with thy light.
ছবিঃ আলমোড়া টি আর এইচ

সন্ধেবেলা আলমোড়া বাজারটা ঘুরতে গেলাম। গুগল ম্যাপ দেখে দেখে আলমোড়ায় বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে পৌঁছে কিনলাম বাল মিঠাই। গাঢ় খয়েরি মিষ্টির ওপরে অসংখ্য সাদা সাদা দানা। মজার দেখতে। খেতেও দারুণ। তারপর হোটেলে ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে লম্বা ঘুম। পরেরদিন সকালে অনেকটা জার্নি। মুন্সিয়ারি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধে হয়ে যাবে।
 ছবিঃ উত্তরাখন্ডের প্রসিদ্ধ মিষ্টি

আলমোড়া জায়গাটাও ভারি সুন্দর। সকালবেলা উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। আবার সেই বুনো গন্ধ, উঁচু উঁচু​ গাছ, পাকদন্ডী রাস্তা। পাশে নাচতে নাচতে ছুটছে ছটফটে একটা নদী। ড্রাইভার বললো...নামবেন নাকি? নামলাম। একটা কাঠের সাঁকো পেরিয়ে নদীর পাশে পৌঁছোলাম। সবুজ ঠান্ডা জল কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। সেই তিরিতিরে ধ্বনি আর ঠান্ডা হাওয়ায় কেমন একটা ঘুম পেয়ে গেল। চারপাশে ঝকঝকে নুড়ি-পাথর। পাথরে মাথা রেখে অচেনা নদীটার পাশে ঘুমিয়ে পড়লাম।

 প্রায় আধঘন্টা পর ডেকে তুললো আমার সঙ্গী। ক্লান্তি জড়ানো পায়ে গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে এসে আবার শুরু করলাম চলা। এবার রাস্তা আরো দুর্গম। পাশে ঝমঝম করে চলেছে নদীটা। রামগঙ্গা। হঠাৎ গাড়িটা এমন একটা পথে ঢুকলো যার দুপাশে অনেক বাড়ি। আর সেই অসংখ্য ছোট ছোট বাড়ির পেছনে মাথা তুলে পিতামহের মতো দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রশিখর হিমালয়। আমরা থ। এত সহজ! বরফ পাহাড় দেখতে পাওয়া এত সহজ!

আসলে এমনই উত্তরাখন্ড। সারা পথ জুড়েই পাশে পাশে হাঁটে হুড খোলা হিমালয়। জায়গাটার নাম ছিল বেরিনাগ। ইচ্ছে ছিল বেরিনাগে আরেকটু দাঁড়িয়ে চোখ সার্থক করি। কিন্তু হল না। বেলা বাড়ছে। ড্রাইভারের তাড়ায় গাড়িতে উঠলাম। দুর্গমতর পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। এবারে খাওয়ার জন্যে নামা হল একটা ছোট্ট হোটেলে। আমার খিদে পায়নি। আমার সঙ্গীরা নদী থেকে ধরে আনা টা্টকা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেলো। হোটেলের বাইরে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধা বেদী মত করা। সেখানে তুলতুলে নরম রোমশ একটা কুকুর ছানা নিয়ে বসে আছে এক মহিলা। আমি তুলোর বলটাকে আদর করে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। মুন্সিয়ারি পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই।  

  ছবিঃ আলমোড়া থেকে

রোদ পড়ে আসছে। একটা হুহু ঠান্ডা হাওয়া ঝাপটা মারছে চোখে মুখে। পথ এবার আরো খাড়া। আরো নিঝুম। খানিকটা গিয়ে গাড়ি দাঁড় করালো ড্রাইভার। কালামুনি টপ। মুন্সিয়ারি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে, উচ্চতা ৯৫০০ ফুট। নেমে যা দেখলাম তাকে ভাষা দেওয়া যায় না। থমথমে গাছেদের পাশে আলতো একটা বাড়ি, আর তার পেছনে সন্ধের নরম, মায়াবী আলো মেখে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট পঞ্চচুল্লী। ওই সম্ভ্রান্ত নির্জনতায়, অপরূপ আলোয়, বরফ শৃঙ্গের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার কথা আটকে গেল। হাতজোড় হয়ে এল আপনা থেকেই মোহগ্রস্তের মতো গাড়িতে উঠে এলাম।


 ছবিঃ কালামুনি টপ

আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মুন্সিয়ারি। থাকছি মিলাম ইন-এ। হোটেলের বাইরেটা দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেল। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে সোজা রুমে। ঘরে ঢুকে আবারও চমক। বিশাল বড় কাচের জানলা জুড়ে নরম আলোয় জেগে আছে সেই পঞ্চচুল্লী, খানিক আগে পথ আটকে ছিল যে। 

ছবিঃ মিলাম ইন-এর রুম থেকে পঞ্চচুল্লী

পরদিন সকালে কাচে প্রথম আলো পড়তেই ঘুম ভাঙলো বিনা অ্যালার্মে। কাঁপতে কাঁপতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। ভোরের চিকন আলোয় অল্প অল্প করে খোলস ছাড়ছে পঞ্চচুল্লী, নীচে মুন্সিয়ারি শহরটাকে স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে। বরফচূড়া রঙ বদলাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। এই লাল, এই হলুদ, এই ঘন নীল। আমি চোখে মেখে নিচ্ছি রঙ। চারপাশে যেন মহা উৎসব। প্রকৃতির আয়োজনে কোথাও কোনও ফাঁকফোকর নেই।

ছবিঃ পঞ্চচুল্লী, মুন্সিয়ারি মিলাম ইন থেকে

আরেকটু আলো ফুটতে চা পেয়ে গেলাম ঘরেই৷ তারপর রেডি হয়ে
, আলুর পরোটা খেয়ে বেরিয়ে গেলাম খালিয়া টপের দিকে। ট্রেক করবো। সবাই বলেছে সোজা ট্রেক। ৮ কিলোমিটারের রাস্তা। ৪ কিলোমিটার হাঁটা, ৪ কিলোমিটার নামা। এদিকে ট্রেকিং পোল নেই। অদম্য উৎসাহে প্রচন্ড খাড়া পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম। দু পা হাঁটি, ৪ মিনিট দাঁড়াই। বেচারা গাইডের অবস্থা দেখে আমারই খারাপ লাগতে শুরু করলো। সে লম্বা লম্বা পা ফেলে খানিকটা এগোয়, তারপর আমার জন্যে অপেক্ষা করে। চারপাশে লম্বা লম্বা হলুদ ঘাস আর ঘন নীল আকাশ৷ পাশে ঝকঝকে হিমালয়। কিন্তু হাঁটতে যেন আর পারি না। রীতিমতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ইতিমধ্যেই  
 ছবিঃ খালিয়া যাবার পথে

খালিয়া টপের উচ্চতা ১১,৫০০ ফুট প্রায়। তিনঘন্টা হাঁটার পরে এসে পৌঁছোলাম অ্যালপাইন রিসর্ট
অপূর্ব সুন্দর রিসর্ট। এইখান থেকে পঞ্চচুল্লির অসামান্য ভিউ পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা এত ধীরে হেঁটে এত দেরিতে পৌঁছেছি যে ইতিমধ্যে মেঘে ঢেকে গেছে বরফ পাহাড়। চারপাশে শুধু মেঘের সমুদ্র।

ছবিঃ অ্যালপাইন রিসর্ট

খালিয়া টপ এখনো বহুদূর। তাড়াতাড়ি কফি আর ম্যাগি খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। ঠিক হল ফেরার পথে এখানেই খাবার খেয়ে নেবো। এবার রাস্তা আরো খাড়া। দু-পা যাই আর গাইডকে জিজ্ঞেস করি... “অউর কিতনা দূর ভইয়া” গাইড বারবারই এক উত্তর দেয়... “বস আ হি গয়ে ম্যাডাম, অউর থোড়া।“ চারপাশে ঘন ঘাসের জঙ্গল। পাথুরে খাড়া পথ। অজানা সব ফুল। আমরা হাঁটছি। গাইড গল্প বলে চলেছে...এই খাড়াই পথে সাইক্লিং হয়, ওই গাছের বাকলে, পাতায় আগে চিঠি লেখা হত... এইসব শুনতে শুনতে হঠাৎ দেখি পাহাড়ের আবহাওয়া পাল্টে যাচ্ছে। তাপমাত্রা হঠাৎ কমে সারা পাহাড় জুড়ে ধোঁয়ার মতো কী যেন উঠছে। আর সমস্ত প্রকৃতির নাভীমূল থেকে যেন উত্থিত হচ্ছে একটাই শব্দ। ঔঁ... ঔঁ... ঔঁ।

ছবিঃ খালিয়া টপ যাবার পথে আলো-ছায়ার খেলা

অবশেষে পৌঁছোলাম খালিয়া টপ। চোখ জুড়ানো বুগিয়ালের মাঝে মস্ত এক কালো পাথর। যেদিকে চোখ যায় তুলো তুলো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। চারপাশে আলোও কমে এসেছে বেশ খানিকটা।  আর দূরের পাহাড় গুলোর গায়ে কোন কোন জায়গায় চুঁয়ে আসা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সরু পাকদণ্ডী পথ। আলোয়-ছায়ায় অপূর্ব এক দৃশ্য
ছবিঃ খালিয়া টপ

বেশ কিছু ছবি তোলার পর এবার আবার নীচে নামার পালা। পা গুলোতে আর কিচ্ছু নেই। ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। ব্যালান্স থাকছে না।  অ্যালপাইনে পৌঁছে রুটি, তরকারি আর ডিমভাজা খেলাম।  পাহাড়ের অত উঁচুতে বলে প্রচন্ড দাম। তারপর সবাই মিলে একটু আগুন পোহালাম, ঠান্ডা খুব বেড়েছে।
নামার শুরু হতেই টের পেলাম... আমি আর পারছি না। এখনও বহু পথ বাকি। এমনিতেই স্বাভাবিকের থেকে কম গতিতে হাঁটছি। গাইড কী বুঝলো... আমাকে দাঁড় করিয়ে গাছের পড়ে থাকা ডাল ভেঙে একটা ট্রেকিং পোল মতো বানিয়ে দিল। একহাতে সেই লাঠি আর অন্য হাতটা গাইডের হাতে...এইভাবে চলেছি। হঠাৎ দেখি গাছপালার ফাঁক দিয়ে আবার প্রতিভাত হয়ে উঠেছে পঞ্চচুল্লী, সূর্যাস্তের আলো তার মাথায় পড়ে মনে হচ্ছে আগুন ধরে গেছে। আমার শরীরে যেন আর বিন্দু মাত্র শক্তি নেই। কষ্টে চোখে জল এসে যাচ্ছে। তবু ওই সোনাঝরা হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল... সার্থক...সব সার্থক।


ছবিঃ খালিয়া টপ থেকে নেমে আসার পথে সোনাঝরা হিমালয়

আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবার আলো একেবারে কমে এসেছে। শুধু চোখ কম আলোয় অভ্যস্ত হয়ে গেছে বলে পথ বুঝতে পারছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম টর্চ আনিনি। গাইডকে ফোনটা দিলাম। ফোনের টর্চের আলোয় পথ চলা শুরু হল। কিন্তু হিমালয় যেন আজ পরীক্ষা নিচ্ছে আমাদের। মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গেল। ঘন অন্ধকার জঙ্গল। বন্য জন্তু বেরিয়ে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এদিকে আমার হাত ছড়ে যাচ্ছে গাছের ডাল ভেঙে বানানো লাঠিতে, অন্য হাতে গাইডের হাত ধরে নামছি খুব সন্তর্পণে। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। পা সম্পূর্ণ অবশ হয়ে গেছে। আমি শুধু একটাই কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি। “ভাইয়া... অউর কিতনা দূর?” বেচারা গাইডও সেই একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছে... “বস ম্যাডাম, আ হি গয়ে” এভাবে আরো অনেকক্ষণ হাঁটার পর কতগুলো টর্চের আলো দেখা গেল। এত দেরি হচ্ছে দেখে খালিয়া দ্বারের গার্ড আর আমাদের ড্রাইভার মিলে আমাদের খুঁজতে উঠে এসেছে খানিকটা ওপরে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম এবার। বাকি রাস্তাটা সেই আলোয় হেঁটে, গাড়িতে উঠে কীভাবে যে হোটেলে পৌঁছেছিলাম...এখন আর মনে পড়েনা। জীবনের প্রথম ট্রেক শেষ হয়েছিল এভাবেই। গাইড ছেলেটিকে ধন্যবাদ দেবার ভাষা ছিল না। 


ছবিঃ আমাদের খালিয়া টপ ট্রেকের গাইড

পরের দিন পায়ে প্রচন্ড ব্যথা নিয়েও ঘুরে বেড়িয়েছিলাম নন্দাদেবী মন্দির, ট্রাইবাল মিউজিয়াম, দারকোট গ্রামতারপর চলে গিয়েছিলাম চৌখরি, বিনসর, কসার দেবীর মন্দির…এইসব জায়গায়। নিখুঁত ছবির মতো সুন্দর সে সবকিছুই। সেসবের কথা আবার কখনও লিখবো সময় করে আজ এটুকুই থাক।  তবে যা লিখলাম আর যা দেখে এসেছি তার মধ্যে হয়তো অনেকখানি ফারাক হয়ে গেল। কেননা…হিমালয়কে দুচোখ ভরে দেখার সেইসব মুহূর্তরা ছিল সদ্য জন্মানো একেকটা নক্ষত্র ভ্রমণকাহিনী আসলে সেইসব মৃত নক্ষত্রের আলো বৈ আর কিছু নয়।


 প্রয়োজনীয় তথ্যঃ পাহাড়ে গেলে ওষুধ সঙ্গে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরী। তবে ওষুধ খাবেন বুঝে। মোশন সিকনেস আর অলটিটিউড সিকনেস এক নয়। যেখানে সাধারণ এভোমিন বা স্টেমেটিলে কাজ হয়, সেখানে অযথা ভয় পেয়ে ডায়ামক্স খেয়ে ফেললে বিপত্তি বাড়বে। অন্যের কথা শুনে সোজা ট্রেক ভেবে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না। খালিয়া টপের মতো ছোট ট্রেক হলেও নয়। সঙ্গে ট্রেকিং পোল ও পাথুরে খাড়াই পথে হাঁটার উপযুক্ত জুতো অবশ্যই থাকা চাই। যারা বিগিনার, নিয়মিত এক্সেরসাইজ ও হাঁটাহাঁটির মধ্যে বিশেষ নেই, তারা খালিয়া টপ ট্রেক করতে চাইলে অবশ্যই রাতটা কাটাবেন অ্যালপাইন রিসর্টে। নইলে পায়ের ব্যথা আর ক্লান্তিতে বাকি ট্রিপটা মাটি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। ট্রেক করা কালীন চিপসের প্যাকেট, জলের বোতল পাহাড়ের যেখানে সেখানে ফেলবেন না। ভালো থাকুন। পাহাড়কেও ভালো রাখুন।








No comments

Powered by Blogger.