মথ ।। গদ্য সংখ্যা ।। এক।।



প্রশান্ত মাজী


আমার হয়নি সে গান গাওয়া 



 অন্তর মম

অনেক দিন আগের কথা। একটি দলে আমরা  কয়েকজন  কোথাও যাচ্ছিলাম একটি  বৃহৎ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মূল্যায়নে। একই গাড়িতে  সবাই। হৈ হট্টগোল এর মাঝে কাজের কথাও চলছে । কোন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের কাজ শুরু করা যায়।  ইত্যাদি। সবাই সে আলোচনায় একে একে অংশগ্রহণ ক'রে তাঁদের বক্তব্য রাখছেন । দলের একজন মহিলা সদস্য  কেবল  তারই মধ্যে একটু যেন  নীরব।  সারাটা পথেই । সে নীলাঞ্জনা ।আমরা কথা বলার  ফাঁকে ফাঁকেই তাকে তাই দেখে নিচ্ছি ওর নামের সঙ্গে দুটি চোখের  সৌন্দর্যের কী গভীর সাদৃশ্য। শরীরে সে  হয়তো কিছুটা স্থুলকায় , অনেকটাই শ্যামবর্ণা।  সে কথা বলছে না তেমন ক'রে ।কিন্তু আলোচনায় প্রবেশ করছে বেশ সক্রিয়ভাবে। সময়ে সময়ে টুকিটাকি লিখিত তথ্য বা  সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তি তুলে ধরছে আমাদের প্রত্যেকের জ্ঞাতার্থে। আমাদের আলোচিত বিষয়গুলি  তৎক্ষণাৎ মন দিয়ে পড়ে নিয়ে , প্রত্যেককে  সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছে    ভুল ভ্রান্তিও । আর আমাদের কলরোলময়  কথাবার্তার মাঝে যে শূন্যস্থান থাকে , সেগুলি পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল নীলাঞ্জনার মহার্ঘ হাসিতে। নির্মল সেই হাসিতে আমরা হচ্ছিলাম স্নাত ,প্রাণিত ।
    ----- নীলাঞ্জনা, কথা বলছে না কেন ?
একজনের জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে নীলাঞ্জনার আবার সেই হাসি উপহার। যা স্বাভাবিক ভাবেই হয়ে উঠছিল
  যেন  বহু প্রশ্নের এককালীন নীরব উত্তর।
আমাদেরই এক প্রাজ্ঞ সদস্য বন্ধু হঠাৎই
   নীলাঞ্জনাকে এক লহমা দেখে নিয়ে নিজের মনে মনেই যেন বলে উঠলেন :
---- নীলাঞ্জনা র মধ্যে রয়েছে আত্মার সৌন্দর্য ।
-----আত্মার সৌন্দর্য ? সে আবার কী ? তা দেখতে পাওয়া যায়
  নাকি ?
আর এক বন্ধু র নিরুপায় প্রশ্ন।
----- অবশ্যই দেখা যায়। বাহ্যিক সৌন্দর্য তো অনিত্য।
  একসময় তা নিস্প্রভ , ম্লান হয়ে যায় ।আর আত্মার সৌন্দর্য হলো নিত্য । সেখানে অন্তর আত্মার পরিচয় পাওয়া যায়। যা মানুষকে বিকশিত করে ভিতরে ভিতরে । বাইরের স্থুল আকর্ষণ থেকে  তার স্থিতি অনেক দূরে ।
-----অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে
      নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে ।
-----হা,, ঋষি কবির প্রার্থনা তো ছিল তাই।শৈশব থেকেই প্রার্থনার দৈনন্দিন অভ্যাসে শিশু মন যেন উদভাসিত হতে শুরু করে । তবেই তো একটা সময় আসবে,যখন নির্মলতা, উজ্জ্বলতা, সৌন্দর্য সারা শরীরের শুধু বাহ্যিক অবয়বে নয়, অন্তরে বাহিরে ঝর্ণাধারায় ছড়িয়ে পড়বে সমানভাবে। অন্তর আর বাহির পৃথকভাবে তখন চিহ্নিত করা যাবে না। আর বলা বেশি, ভিতরের সৌন্দর্যই তো প্রকৃত সৌন্দর্য। যা দেখতে পাচ্ছি আমাদের নীলাঞ্জনার মধ্যে।
----- মন আর মুখ তখন একাকার হয়ে যায় ?
----হ্যা, মনের মালিন্য চলে গেলেই তো
  , তা এক পরিষ্কার দর্পণ। তাতে মুখও দৃশ্যমান হবে পূর্ণ অবয়বে । আত্মার জ্যোতিতে  তো জড়বস্তুর প্রকাশ ঘটে। তেমনি, সেই জ্যোতিতে যদি স্থুল শরীর হয় আলোকিত, আত্মার সব বৈশিষ্ট্যগুলো তা লাভ করে এবং নিত্যবস্তু রূপে তার প্রকাশ ঘটে সে  তখন খর্বকায় , কৃষ্ণকায়  না শীর্ণকায় এসব তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্নোত্তরে এত সব ভারী ভারী
  কথা চললো দুই বন্ধুর মধ্যে ।  নীলাঞ্জনার সামনেই । নীলাঞ্জনা  নত মস্তকে ,  শোনে এইসব । হয়ে যায় যেন  সে আধেকলীন ।  কিন্তু হৃদয়ে দূরগামী।
এতদিন তবে কি আমরা চোখ মেলেছি শুধু বাহির পানে ?



নীলাঞ্জনাকে সামনে রেখে আমরা সেদিন তাকালাম  কিছুটা  হৃদয়পানে ।







সেদিনের সত্যজিৎ রায়


সত্যজিৎ রায়ের মতো অত বড়ো ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কিছু বলতে বা লিখতে গেলে সংকোচ হয় খুব কদিন আগেই তাঁর একটি ছবির শুটিং এর একটি অংশ দেখতে গিয়ে ভাবছিলাম এইসব সূত্রে যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁরা কী ভাগ্যবান !এক শিশু শিল্পীকে বারবার নির্দেশ দিচ্ছেন একটি মুহূর্তকে নিখুঁতভাবে অভিনয় করার জন্য । বিরক্তি তো নেই , শরীরের রুগ্নতা সত্ত্বেও কী আনন্দে কাজটি তিনি করে যাচ্ছেন ।
একবার তাঁর সঙ্গে আমার শুধু দেখা নয় কথাও হয়েছিল ।ভাবলে অবাক হই আজ।সবে বর্ধমান থেকে কলকাতা এসেছি । তিনি তখন খ্যাতির চূড়ায় । কিভাবে যেন আমন্ত্রণ পেয়ে তাঁর হীরক রাজার দেশে ছবিটির প্রিমিয়ার শো দেখতে গিয়েছি শিশির মঞ্চে । সঙ্গে দুজন বন্ধু । আর ছিলেন সেসময়ের দিকপাল একদল লেখক, সাংবাদিক, শিল্পীর দল।অপর্ণা সেন , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আরও কত যে জন ।
ছবি দেখার শেষে , বাইরে দাঁড়িয়ে একটু গল্পগুজব করে সবাই ফিরে যাচ্ছেন। সত্যজিৎ রায় , তাঁর গাড়ি এগিয়ে আসতেই , গাড়ির সামনের দরজা খুলে সবে বসেছেন।তিনি তো সামনে সিটে ড্রাইভারের পাশেই সর্বদা বসতেন । কী কারণে যেন গাড়িটির স্টার্ট নিতে দেরি হচ্ছিল । আমার হঠাৎ মনে হল এই সুযোগে আমি তো আমার কথাটা বলে নিতেই পারি !অনেকদিন ধরেই তাঁর কথাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু তাঁকে ধরাই তো কঠিন কাজ । কথাটি আর কিছু নয় । আমরা সেসময় আমার সম্পাদিত 'প্রতিবিম্ব' পত্রিকায় র প্রতি সংখ্যায় লেখক শিল্পীদের বইপড়া নিয়ে কিছু স্বীকারোক্তি প্রকাশ করছি । বর্ধমানে থাকাকালীন তা শুরু হয়েছিল ।কলকাতাতেও লেখকেরা অনেকেই খুব আগ্রহ প্রকাশ করায় বিভাগটি চলছিল বেশ। একেকটি সংখ্যার প্রকাশ ঘটে আর সবাই দেখে নেন কার কোন বই প্রিয় । আমাদের প্রশ্নগুলো ছিল অতীব সহজ ও সরল
আপনার প্রিয় দশটি বাংলা বই কী ?আপনার প্রিয় পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ কী ? দশটি বাংলা গল্পের একটি সংকলন করার দায়িত্ব পেলে কোন কোন গল্প নেবেন ?আর গত একবছরে আপনার পড়া উল্লেখযোগ্য বই বা রচনা কী ?বলছি বটে সহজ ছিল, অনেককে দেখতাম কী কসরতই না করছেন উত্তর দিতে গিয়ে । দিতে রাজিও হচ্ছেন না অনেকেই । নিকট বন্ধুদের ক্রোধের কারণও হতে চান না কেউ ।আবার কোনও কারণে না দেখিয়ে নীরব থেকে যান এমন লেখকদেরও দেখেছি  
সেদিন শিশির মঞ্চের বাইরে সত্যজিৎ রায় মশাইয়ের কাছে গিয়ে অতীব দ্রুততার মধ্যে ওই প্রশ্নগুলো কোনরকমে রাখতে পেরেছিলাম । সব শুনে তিনি তাঁর বিখ্যাত ব্যারিটোন স্বরে বললেন ,কত বই তো প্রিয় আছে । মাত্র দশটির নাম ? আমি তখন অকুতোভয় । পালাতে চাই না ।
আমি বলি ,দেখুন,জামা কাপড় কিনতে গিয়ে আমরা তো অনেক নমুনাই দেখি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিনি হয়ত একটি বা দুটি
তাহলে দশটি প্রিয় বইয়ের নাম বলতে অসুবিধা কী , বলবেন অনুগ্রহ করে ? আমাদের যে খুব প্রয়োজন আপনার মত একজন পাঠকের এই স্বীকারোক্তি । এখনও মনে আছে তিনি মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির দরজা খুলে নেমে এসে বললেন , "আপনার পরিকল্পনা টি ভারী ভালো। আপনি একদিন আসুন বাড়িতে । অবশ্যই ফোন করে ।''

বড়ো দুঃখের কথা । আমি আমার চিরকালীন ভালোবাসার আলস্যকে সরিয়ে রেখে আদৌ আর তাঁর বাড়িতে যেতে পারিনি ।শুধু তখন নয় , পরেও নয় ।এই গল্পটা এক সভায় বেশ নাটকীয়ভাবে বলি । সব শুনে আমাদের প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষ আমাকে বলেছিলেন আপনার যাওয়া উচিত ছিল । এ গল্পের এই পরিণতি হবে , ভাবিনি ।

আমি আজও ভাবি , সত্যিই তো , ওই প্রশ্নগুলির উত্তর সেদিন সংগ্রহ করে রাখতে পারলে , আমরা বাংলা বইয়ের উত্তম পাঠককুলের জন্য এক টুকরো মূল্যবান সম্পদ তো তুলে দিতে পারতাম ! তাই না ? বড়ো ভুল হয়েছে আমার । সত্যজিৎ রায় ফিল্ম নিয়ে , বিদেশি বই নিয়ে অনেক লেখা লিখেছেন , কিন্তু তাঁর পড়া বাংলা বই নিয়ে লেখা ? আছে কি ? জানি না ।

আর কে একথা অস্বীকার করবে যে ভালো বই হল সেই বন্ধু যা মানুষকে প্রতারণা করে না কখনোই ।বলিভিয়ার জঙ্গলে , শুনেছি চে গুয়েভারা একটা দোলনায় শুয়ে বসে দিনরাত
  শুধু গ্যয়টে পড়তেন।












 
রামচন্দ্র প্রামাণিক


তীর্থদর্শন


উনিশশো আটানব্বই কিম্বা নিরানব্বইআমি তখন কলকাতার ন্যাশানাল ইন্সিওরেন্স কোম্পানির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা । প্রায়ই যেতে হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোম্পানির কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পুনের রিজিওনাল অফিসে একটি মিটিং ছিল। সেখানে শুনলাম পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর ভাগ্নে কাজ করেন ওই অফিসে। আমি তো রীতিমত চমৎকৃত। ডেকে আলাপ করলাম তাঁর সাথে। অত্যন্ত সদালাপী ওই মারাঠি ভদ্রলোক নিজেও একজন সংগীতজ্ঞ। কাছাকাছি অনুষ্ঠান হলে এবং সময় সুযোগ মিললে তিনিও নাকি বসে পড়েন পণ্ডিতজীর পিছনে --- সারেঙ্গী হাতে। 
আমার উদ্ভাসিত চোখমুখ দেখে তিনি নিজে বললেন --- দেখা করবেন মামুর সাথে ? আমি জানতে চাইলাম সেটি সম্ভব হবে কী না এবং হলে --- কবে,  কখন ? উত্তরে জানালেন পড়ে গিয়ে একটি পা ভেঙে সেই প্লাস্টার করা পা নিয়ে তিনি এখন শয্যাগত পুনের বাড়িতেই আছেন অসুস্থ মানুষকে বিড়ম্বিত করতে আমার দ্বিধা তিনি সহাস্যে উড়িয়ে দিলেন ফোন করলেন মাতুলালয়ে
সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।  মিটিং মাথায় উঠল অফিসারটি নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে নিয়ে চললেন তাঁর মাতুল পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর বাড়িতে
প্রথমেই এক ঝলকের বিহঙ্গদৃষ্টিতে কেমন দেখেছিলাম সেই বাড়িটা তা বলা দরকার একটি বাড়ি বৃহৎ বাংলো , বেশ খানিকটা জমির মাঝখানে  অত বড়ো শিল্পী,  অর্থাগমের সুযোগ যার সুপ্রচুর , তাঁর ভদ্রাসন বলে মনেই হয়না মেন গেট দিয়ে ঢুকলে মনে হয় না অমন ভারত বিখ্যাত একজনের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়লাম না বাগানে না বাড়িতে ------ কোথাও নেই সেই বৈভবের বিভূতি,  চোখে পড়ার মতো চাকচিক্য
সদরে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন প্রান্ত যৌবন এক ভদ্রলোক ---- কপালে টিকাধারী টিপিক্যাল ব্রাহ্মণ ---- যিনি, পরে জানলা্,  পণ্ডিতজিরপুত্র  ( সম্ভবত জ্যেষ্ঠ)
আমাকে তিনি তাঁর পিতার শয়নকক্ষে নিয়ে গেলেন। একটি নীচু খাটে প্লাস্টারকরা পা-খানি লম্বা লম্বা করে বাড়িয়ে পিঠে বালিশ দিয়ে তিনি আধশোয়া হয়ে রয়েছেন। খাটের পাশে একটি চেয়ার রাখা যেখানে বসে আছেন এক সাধারণদর্শন প্রায়বৃদ্ধা মহিলা—তাঁর স্ত্রী। অন্যদিকে রাখা শূন্য কাঠের চেয়ারখানি অতিথিদের জন্য যেখানে তিনি আমাকে বসতে বললেন। আমি যতক্ষণ ছিলাম তাঁর পুত্রটি দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝলাম সেটিই এই গৃহের রীতি।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। বিশাল শয়নকক্ষটির অনাভরণ গৃহশয্যা, আসবাবপত্র, খাট এবং বিছানার চাদর-বালিশ ইত্যাদি দেখে যে কেউ ভাববে এটি একটি রুচিসম্পন্ন মধ্যবিত্ত বাঙালী গৃহ। শুধু পার্থক্য এটাই যে দেয়াল ঘেঁষে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র রাখা।
পণ্ডিতজি এবং তাঁর স্ত্রীকে প্রণাম করলাম। মাথায় হাত দিয়ে তিনি আশীর্বাদ করলেন। আমাদের অফিসার তাঁর ভাগ্নে – যিনি মামাতো ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ---- আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পণ্ডিতজি স্বভাবসুলভ নিচু স্বরে কলকাতার খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, প্রতিবার ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্সে তিনি সংগীত পরিবেশন করেন এবং খুব আনন্দ পান। এমন সমঝদার শ্রোতা অন্য কোন শহরে নেই। যখন শুনলেন যে আমিও সেই ডোভার লেন-এই থাকি এবং সেই সংগীত সম্মেলনের নিয়মিত শ্রোতা, তিনি খুশি হলেন খুব।
ইতিমধ্যে একটি তরুণ, গৃহভৃত্য বোধহয়, কক্ষটির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে --- ট্রে হাতে। পণ্ডিতজির পুত্র     ( নাম ভুলে গেছি ) এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে ট্রে-টি নিয়ে আমার সামনের নিচু চায়ের টেবিলটায় রাখলেন। প্লেটে সাজানো হরেকরকম মিষ্টান্নপণ্ডিতজি বললেন – খাও , খেতে খেতে গল্প হবে।
সেই ছেলেটি আবার এসে দাঁড়িয়েছে দরজার পেছনে। হাতে আর একটি ছোট ট্রে যাতে প্লেটের ওপর বসানো চায়ের কাপপণ্ডিতজির পুত্র এগিয়ে গিয়ে সেটিও নিয়ে এলেন এবং আমার সামনে রাখলেন চা-পান পর্ব অতিক্রান্ত হলে, লক্ষ করলাম, সেগুলো এবারও নিয়ে গেলেন পণ্ডিতজির জ্যেষ্ঠ পুত্র। দিয়ে এলেন দরজার সন্নিকটে দাঁড়ানো ছেলেটিকে। বুঝলাম এটিই ওই মহান শিল্পীর গৃহে প্রতিষ্ঠিত রীতি। অতিথিকে চা-জলখাবার দিয়ে আপ্যায়ন করবেন স্বয়ং গৃহকর্তা অথবা গৃহেরই অন্য কেউ। কাজের লোক কখনোই নয়।
পণ্ডিতজি যখন সংগীতবিষয়ক কথাবার্তায় ঢুকছেন , ত্রস্ত ভঙ্গিতে বললাম --- আমি একেবারেই অশিক্ষিত শ্রোতা। বরং আমার স্ত্রীর সামান্য ট্রেনিং আছে। আমি কেবল তার সাথি হিসাবে ভালবেসে এবং আগ্রহ নিয়ে শুনি --- এই পর্যন্ত। উনি তখন জিজ্ঞেস করলেন আমার স্ত্রী কার কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। সবিনয়ে বললাম, সেও কোন বিখ্যাত ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধে শেখেনি। তার শিক্ষাও সামান্য, অত্যন্ত অখ্যাত শিক্ষকের কাছে। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন --- অখ্যাত হলেই সে শিক্ষক সাধারণ হবেন এমন কোন মানে নেই।
তিনি ইঙ্গিত করে কথ্য মারাঠিতে কিছু বললেন তাঁর ছেলেকে। ছেলে গিয়ে দেওয়াল-আলমারি থেকে গোটা দশেক ক্যাসেট নিয়ে এলেন ( তখন ক্যাসেটই ছিল ) এবং ক্যাসেটের কভারের কাগজগুলো বের করে পণ্ডিতজির হাতে এগিয়ে দিতে লাগলেন। ড্রয়ার থেকে বের করে দিলেন একটি কলমও। পণ্ডিতজি প্রত্যেকটির উপর যত্ন নিয়ে দস্তখত করলেন --- ‘ভীমসেন যোশী’।
অসুস্থ মানুষকে আর বিব্রত করা উচিত হবে না। আমার অফিসার ক্যসেটগুলো হাতে তুলে নিলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বললাম – আমি সামান্য মানুষ । তিনি মৃদু হেসে বললেন -ম্যায় ভি। আমি আবার বললাম – গান কখনো শিখিনি। গানের কিছুই বুঝি না। তবু আপনার গান শুনতে শুনতে মনে হয় যেন অনেক কিছু বুঝলাম। অল্পক্ষণের জন্য হলেও যেন স্বয়ং ঈশ্বরের স্পর্শ পেলাম। তিনি বললেন- এই জন্য কলকাতার মানুষদের এত ভালবাসি, এখানেই কেবল এরকম শ্রোতা আছে। একজন-দুজন নয় , অজস্র।
আর কখনও তাঁর সামনে যাইনি। যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে সেই একটি দিনের স্মৃতি আমার কাছে তীর্থদর্শনের পুণ্য স্মৃতি। তাঁর অন্য কিছু অনুকরণ করার সাধ্য তো আমার নেই। শুধু অতিথি এলে আমি এবং আমার স্ত্রী মনে রাখি --- আপ্যায়ন করবেন স্বয়ং গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্ত্রী ( দ্বিতীয় আর কেউ নেই আমার গৃহে ) কাজের লোক কক্ষনো নয়। এবং মনে রাখি তাঁর অযাচিত করুণা ---- অজ্ঞাত অখ্যাতর জন্য। তাঁর অমুল্য স্বাক্ষরযুক্ত ক্যাসেট কিন্তু আমি চাইনি। তিনিই দিয়েছিলেন উপযাচক হয়ে। একটি দুটি নয়। দশটি। 



ছবিঃ অমিতাভ ঘোষ 


গৈরিক গঙ্গোপাধ্যায়  


নদীর পাড়ে চড়ুইভাতি

আমাদের বাড়ি থেকে একটু হাঁটলেই বাঘমুন্ডি রোড। পাকা রাস্তা। এঁকে বেঁকে চলে গেছে বাঘমুন্ডি পর্যন্ত। থুড়ি, চলে গেছে বাঘমুন্ডি পার করে, পার করে ছৌ-নাচের মুখোশ তৈরির গ্রাম ‘চড়িদা’কেও। ওই রাস্তা দিয়েই মাঠা এবং অযোধ্যা পাহাড়েও যেতে হয়। না, অতদূর যেতে হবে না তোমাদের। তার অনেক আগেই, এই ধরো ছয় কিলোমিটার গিয়েই তোমায় কাঁচা রাস্তায় নামতে হবেপ্রথম ছয় কিলোমিটারের মধ্যে চার কিলোমিটারই রাঙ্গাডির বন- যার ঠিক মাঝ বরাবর রাস্তাটা চলে গেছে। তারপর ডানদিকে কাঁচা পথ শুরু হচ্ছে।
সেই লাল মোরামের পথে, যাতে গরুর গাড়ি আর রিক্সার টায়ার লাগানো সাইকেলের চাকার দাগ, যেতে হবে আরও আট কিলোমিটার। পথে পড়বে পাথরবাঁধের নামো। বাঁধ মানে জানো? বাঁধ মানে পুকুর। অর্থাৎ পাথরবাঁধ মানে পাথরের পুকুর। বহুকাল আগে ওখানে একটা নীলকুঠি ছিলো। সেই নীলকরত সাহেবরা জলের প্রয়োজনে পাথরের চাটান ফাটিয়ে জল বার করেছিলো। তাই পাথর বাঁধ। আর নামো মানে ঢালু জায়গা। নীলকুঠিটার ভগ্নাবশেষ এখনও আছে সেখানে।
যাক সে কথা। ওই জায়গায় খুব উঁচু একটা জারুল গাছের মাথায় শকুনির বাসা। রাস্তাটা ওইখানে এতই ঢালু যে ওখান দিয়ে সাইকেল চালিয়ে নামা যায় না। সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে যেতে হয় পা চেপে চেপে। পথেই ‘নেকড়ে’ গ্রাম পড়বে, পড়বে ‘গেঁড়ুয়া’। রাস্তা থেকে নেমে বাঁপাশে বনের পথ একটু মাড়ালেই পাবে একটা বাতিল হয়ে যাওয়া অভ্রখনি। অভ্র কাকে বলে তা নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গেছো তোমরা। ওই যে গো, যা দিয়ে ইলেকট্রিক ইস্ত্রি তৈরি হয়। আর যা গুঁড়ো করে দোলের সময় আবিরে মেশায়। যাবার পথে অবশ্যই দেখে যাবে খনিটা। পাতার ফাঁক থেকে গড়িয়ে পড়া ছিটে-ফোঁটা আলো সেখানে সোনা-রূপোর জেল্লা ছড়ায়। পায়ে পায়ে এবং বাতাসে ভাসিয়ে সেই সোনার ছোঁয়া মাঝেমাঝে রাস্তাতেও।

আমরা চিরুগোড়া যেতাম শীতের শেষাশেষি। যখন বন তার ঝিমুনি কাটিয়ে উঠে দোল খেলছে শাখায় শাখায়। রাঙ্গাডির শাল-পলাশের জঙ্গল তখন নীল আকাশের নীচে লালে লাল। আমাদের বড় দাদা দিদিরা গলা ছেড়ে গান ধরতো- “ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে
                                                      ফুলে ফলে ডালে ডালে পাতায় পাতায় রে
                                                         আড়ালে আড়ালে কোনে কোনে...”
রাস্তায় আমরা ছাড়া জন-মনিষ্যি নেই। তবু রাঙ্গাডির বন, তার শাল, সেগুন, পলাশ গাছরা যেন খুব মন দিয়ে সেই গান শুনতো। রাস্তা পার করে এপাশ থেকে ওপাশের বনে চলে যাবার সময় দু’একটা ধূসর রঙের মেঠো খরগোশও কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে পড়তো কখনো সখনো।
আমাদের আগে আগে গরুর গাড়িতে মা, ঠাকুমা আর পিসিরা থাকতেন। ঐ গরুর গাড়িতেই যেত মালপত্রও। হাঁড়ি, কড়াই, হাতা, খুন্তি- মানে চড়ুইভাতি করতে যা যা লাগে আর কি। আর হ্যাঁ! খোলা আকাশের নীচে একটা চড়ুইভাতি তো, তাই রান্নার জায়গাটা ঢাকবার জন্য একটা ছোটো ত্রিপলও নেওয়া হতো। আমরা অর্থাৎ বাবার সঙ্গে আমরা দুই ভাই, আমাদের পিসতুতো ভাই বোন ও দাদা দিদিরা আর বাবার সাঙ্গপাঙ্গরা সব হেঁটেই যেতাম। ওই গরুর গাড়ির পিছন পিছন। বাবার সাঙ্গপাঙ্গ বলতে শ্রীপতি জ্যেঠু- যিনি ঠাকুর্দার খাস লোক ছিলেন, রামদা অর্থাৎ রামচরণ মাঝি- যিনি আমাদের বাড়িতেই মানুষ হয়েছেন আর আমরা যাঁর কোলে চড়ে বড়ো হয়েছি, কাঁদরু- যে গোরুদের দেখাশোনা করতো আর বুধু ঠাকুর- রাঁধুনি।
ঠাকুর্দার বেলজিয়ান দোনলা বন্দুকটা বাবার কাঁধে থাকতো। কারণ তখনও চিরুগোড়ায় নিয়মিত চিতাবাঘ আর ভালুক বেড়োত। সে যেন পিকনিক নয়, যুদ্ধে যাওয়া।
এই দ্যাখো! বকবক করতে করতে আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেছি তোমাদের। আমরা কোথায় যাচ্ছি সেটাই তো এখনও বলা হয়নি। যাচ্ছি একটা ছোট্ট পাহাড়ি নদী ‘চিরুগোড়া’র পাড়ে। সেখানেই চড়ুইভাতি।
ওইভাবেই গোরুর গাড়ির পিছন পিছন হেঁটে যাওয়া। তা আরো দু’কিলোমিটার হবে। রাস্তাটা কেবল নীচু হতে হতে দু’পাশের বাদাম খেতে মিশে যাবে। আর ঠিক সামনে দেখবে চারিদিকে সাদা বালির মধ্যে দিয়ে এক হাঁটু জল নিয়ে অনেক ছোটো বড়ো পাথরকে পাশ কাটিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে ছোট্টো একটা নদী- চিরুগোড়া। যেই চোখ তুলবে, নদীর ওপারে দূরে চোখ আটকে যাবে এক সারি পাহাড়ে। যত রাজ্যের ভো-কাট্টা মেঘগুলোকে লোটার চেষ্টা করছে তারা। অয্যোধ্যা!
 আমরা এক ছুটে নদীর চড়ায়। তারপর হুটোহুটি, ছুটছুটি আর লুটোপুটি। এরই মধ্যে বড়রা নদীর পাড়ের ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে ত্রিপল টাঙিয়ে রান্নার জায়গা করে ফেলতো। ততক্ষণে ছোটোরা দু’একজন জলেও নেমে পড়েছে।
ঘরের অ্যাকুয়ারিয়ামে তোমরা সবাই গায়ে ডোরাকাটা সরু সরু জেব্রা মাছ তো দেখেইছো। সেই মাছে নদীটা ভর্তি। কেউ কেউ গামছা দিয়ে উজান যেতে চাওয়া সেই মাছগুলো ধরছে। আর তারপরে কি করছে জানো? হাতে করে পাড়ের বালিতে গর্ত করছে আর সেখানে গামছায় ধরা সেই মাছগুলো ছাড়ছে। পাহাড়ী নদীর পাড়ের বালিতে যেখানেই একটা বাটির মতো গর্ত করবে সেখানেই জল।
ভারি মজার নদী চিরুগোড়া। আমরা যেখানটায় জলে নামতাম, তার আধ মাইল দক্ষিণেই একটা ছোট্টো  জলপ্রপাত ছিল। জলপ্রপাত বললেই যাদের ভিক্টোরিয়া বা নায়াগ্রা জলপ্রপাত মনে পড়ে, ওটা তাদের জন্য নয়। এ এক্কেবারে ছোট্টো মাপের। সেখান থেকে জলের সঙ্গে ভেসে গিয়ে নীচে পড়লেও তোমার কিচ্ছুটি হবে না। আমাদের তো সেটা খেলাই ছিল। একবার করে জলে গা ভাসিয়ে দেওয়া আর গড়গড় করে নীচে গিয়ে পড়া। আবার উঠে আসা। আর ওই প্রপাতের কিছু আগে নদীর উপরেই ছিল তিনটি প্রাকৃতিক স্নানাগার। হ্যাঁগো চানঘর! ঈশ্বরই জানেন প্রকৃতি কোন খেয়ালে তাদের বানিয়েছিলোতিনদিকে খাড়া পাথরের নীচ দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। একটি চানঘরের আবার মাথাতেও পাথর ঢাকা ছিল। চাইলে লোকের চোখের আড়ালেও তুমি স্নানটা সারতে পারো।
স্নানের পরে খেতে বসার আগে বন থেকে শালপাতা জোগাড় করে ছোটোদের প্রত্যেককে নিজেদের থালা বানাতে হতো। বানাতে হতো বড়োদের জন্যও। সেসব হয়ে গেলে খেতে বসা নদীর পাড়ে- বালিতেই। ততক্ষণে ছোটোরা দারুণ কাহিল। খিদেয় প্রাণ বেড়োচ্ছে। ওই সময়ে দেখেছি বড়োরা নতুন করে কিছু করতে বললে, যে বুধু ঠাকুর বাবাকে যমের মতো ভয় পেতো, সেও বলতো আমাদের হয়ে। ‘হঁঃ হইল্য! ইবার ব্যস করো দাদাবাবু। ছ্যালাগুলাকে টুকুন খাতে দাও!’ বাবা মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলতেন।
তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম। সব গোটাতে, জিনিসপত্র গোরুর গাড়িতে তুলতে তুলতে আলো কমতে শুরু করতো। ফেরার আগে নিয়ম ছিল পাড়ের গর্তগুলোয় আটকে রাখা সব জেব্রা মাছেদের নদীতে ছেড়ে দেওয়াহাতে কুড়োনো চক্‌মকি পাথরের টুকরো আর আর বড় মনখারাপ নিয়ে বাড়ির পথ ধরতাম। গোরুর গাড়িটার পিছনের দিকে নিচে একটা লণ্ঠন ঝোলানো থাকতো, কেন কে জানে! আর পদাতিক বাহিনীর হাতে থাকতো একটা পাঁচশেলের এভারেডি টর্চ। তবে বিশেষ জ্বালতে হতো না। পূর্ণিমার আশে পাশে হলে তো কথাই নেই, একমাত্র অমাবস্যা ছাড়া খোলা আকাশের নীচ দিয়ে পথ চলতে এমন কি বনের মধ্যেও টর্চের বিশেষ দরকার হয় না।
রাত্রি নামতে নামতে রাঙ্গাডির বন এসে পড়তো। আমাদের চাঙ্গা করতে বড়োরা গান ধরতেন-
‘আয় পুরুল্যা, যায় পুরুল্যা
পুরুল্যায় তোর কে আছে?
পুরুল্যারই রাস্তার ধারে খিল পান গুঁজা আছে
বল টু..উ..সু.. যাব...অ.. অ..’ 
আমরাও গলা মেলাতাম নতুন উৎসাহে। দূরে বরাভূম স্টেশানের গ্যাসবাতি আর তার ঠিক পিছনেই আমাদের বাড়ির হ্যাজাকের আলো দেখা যেতো। 





৩১৫ আপ

রেলগাড়ি কত রকমের হয় জানো? রেলগাড়ি হয় তিন রকমের। লোকাল ট্রেন, দূরপাল্লার ট্রেন আর যে ট্রেনটা তোমায় দেশের বাড়িতে নিয়ে যায়, সেই ট্রেন। আর ঐ শেষ রকমের ট্রেনটা সম্পর্কে আমাদের সকলেরই একটা আলাদা দুর্বলতা থাকে , তাই না?
আর ঠিক এই কারণেই, যে হাওড়া-আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারের ভাঙ্গাচোরা, টোল খাওয়া, মরচে ধরা চেহারাটা দেখে ভালো লাগার কথা মোটেই নয়, তাকেও আমার ভীষণ ভালো লাগে—আজও। বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে যায়—হঠাৎই। কারণ  ‘৩১৫ আপ’ আমার কাছে কেবল একটা রেলগাড়ি নয়। সে আমার ছেলেবেলার সঙ্গে আজকের পৃথিবীর যোগসূত্র (সেতু)। সে যেন একটা ‘টাইম মেশিন’। চড়ে বসলেই (আমায়) নিয়ে যাবে শৈশবের সব মধুর স্মৃতিতে।
সারা বছর শুধু তাকিয়ে থাকতাম বছর শেষের ঐ আনন্দটুকুর জন্য। অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হওয়ার অপেক্ষা কেবল। তারপরেই চড়ে বসা ঘরমুখো ট্রেনে। সেখানে অপেক্ষা করে থাকতো পাহাড়ে চড়া, নদীর পাড়ে চড়ুইভাতি, বনের থেকে অজানা নানারকমের গাছের পাতা জোগাড় করে হার্বেরিয়াম বানানো, টুসু পরব, চক্‌মকি পাথর কুড়োনো, লণ্ঠনের আলোয় ভূতের গল্প শোনা ইত্যাদি হাজার মজা।
ক্রিসমাসের ছুটি প্রায় এক মাসের ছিলো। ৩১৫ আপ তখন কয়লার (স্টিম) ইঞ্জিনে চলতো। কারণ খড়্গপুর থেকে আদ্রা—এই পথটুকু তখনও ইলেকট্রিফিকেশান (ইলেকট্রিক) হয়নি। যেহেতু দক্ষিণ-পূর্ব রেলের বাতিল বগীগুলো বরাদ্দ হতো হাওড়া-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারের জন্য, তাই বাবা ট্রেনে উঠেই বার্থগুলো ঠিক আছে কিনা এবং জানলাগুলো আদৌ আছে কিনা বা থাকলেও বন্ধ হয় কিনা দেখে নিতেন। থাকলে বাবা-মায়ের শান্তি, না থাকলে আমাদের পোয়া-বারো (মজা)।
চলতে শুরু করলে কত কাজ ছিলো আমাদের—দু ভাইয়ের। প্রথমে স্টেশানগুলোর নাম লেখা এক এক করে। তারপর প্যাসেজ দিয়ে অকারণে খানিক হাঁটাহাঁটি করা। জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে দেখা চাঁদ ঠিক মতো আমাদের সঙ্গে তাল রেখে যাচ্ছে কিনা। আরো একটা কাজ ছিলো, সেই গানটা গাওয়া—
“ইলেকট্রিক ট্রেন চড়ো না
ছেড়ে দিলে উঠো না
এমন মজা পাবে না
চোখে কয়লা যাবে না......
ইলেকট্রিক ট্রেন...
দুই ভাইয়ে মিলে আপার বার্থে চেঁচামিচি করতে করতে ঠিক মধ্যরাতে যখন চোখটা লাগতো, তখনই ট্রেনটা খড়্গপুর ঢুকতো। বাবা ডিমসিদ্ধ কিনে আমাদের দেকে তুলতেন। খড়্গপুরে এক ঘণ্টারও বেশী সময় দাঁড়াতো ট্রেনটা, বাথরুমে জলভরা, ইঞ্জিনে কয়লা তোলা ইত্যাদির জন্য। পৃথিবীর দীর্ঘতম (সবচেয়ে লম্বা) প্ল্যাটফর্মে শীতের মাঝরাতে চাওয়ালারা হেঁকে যেতো ‘চায় গরম, গর্ম চায়’।
ট্রেন ছাড়লেই আমরা আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুমের মধ্যেই পেরিয়ে যেতো মেদিনীপুর, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া। ঘুম ভাঙতো ভোরে ট্রেন আদ্রা ঢোকার মুখে (আগে)।
আদ্রায় আবার একঘণ্টা দাঁড়ানো। স্টিম ইঞ্জিল বদলে ইলেকট্রিক ইঞ্জিল লাগানোর জন্য। ঐ সময় বড়দের সঙ্গে স্টেশানে (প্ল্যাটফর্মে) নেমে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে গরম গরম ভাজা অমৃতি খেতাম আমরা।
আদ্রা ছাড়লে পুরুলিয়া পাঁচটা স্টেশান—গড় ধ্রুবেশ্বর, আনাড়া, কুশটাঁড়, বাগালিয়া, ছররা। ঐ সব স্টেশানের প্ল্যাটফর্ম এত নীচু ছিলো যে সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকেও লাফিয়ে নামতে হতো স্টেশানে। জাংশন স্টেশান পুরুলিয়ায় রিজার্ভ বগী খালি হয়ে যেতো। পাশের প্ল্যাটফর্ম থেকে ঐ সকালেই ছাড়তো ন্যারো গেজের ‘কোটশীলা প্যাসেঞ্জার’। ন্যারো গেজ কাকে বলে জানো তোমরা? আমরা সবসময় (সাধারণত) যে ট্রেনে চড়ি সে ট্রেন চলে ব্রড গেজে। তার থেকে সরু লাইন হলো মিটার গেজ অর্থাৎ যে রেলপথ কেবল ১ মিটার চওড়া। আর তার চেয়েও সরু যে রেলপথ সেটাই হলো ন্যারো গেজ- যা মাত্র আড়াই ফুটের মতো চওড়া। বেশ মজা লাগতো সেই রেলগাড়ি দেখতে। এইটুকু স্টিম ইঞ্জিন সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট দুটো বগী আর গার্ডের কামরা। মাত্র কয়েকজন লোক নিয়ে সেই ট্রেন যখন ঝুক ঝুক করতে করতে আমাদের উল্টোমুখো যেতো ভারি সুন্দর লাগত দেখতে।
আমাদের ট্রেন পুরুলিয়া ছাড়লে খালি কম্পার্টমেণ্টে বার্থ থেকে বার্থে লাফিয়ে বেড়াতাম আমরা দু ভাই। ওই সময় বাবা আর মা শুরু করতেন বেডিং বাঁধা, ট্রাঙ্ক গুছোনো। এসব করতে করতে পেরিয়ে যেতো কাঁসাই নদীর ব্রীজ, টামনা, কাঁটাডি, উরমা স্টেশান। উরমা স্টেশান ছাড়লে ডানদিকের জানলা দিয়ে দূরে দেখা যেতো কালাপাহাড়। ক্রমশঃ সে পাহাড় বড়ো হতো। আবার তাকে পেরিয়ে ট্রেন এগিয়ে গেলে ছোটো হতে থাকতো একটু একটু করেদূরে দেখা যেতো বলরামপুর শহর। বাঘমুন্ডি রোডের লেভেল-ক্রশিং পেরিয়ে বরাভূম স্টেশানে ঢোকার আগেই আমরা দরজায়। লোকজন নিয়ে আমাদের নিতে এসে দাদু প্ল্যাটফর্ম থেকে হাত নাড়তেন।

No comments

Powered by Blogger.