আমার হয়নি সে গান গাওয়া

প্রশান্ত মাজী

 অন্তর মম

 
অনেক দিন আগের কথা। একটি দলে আমরা  কয়েকজন  কোথাও যাচ্ছিলাম একটি  বৃহৎ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মূল্যায়নে। একই গাড়িতে  সবাই। হৈ হট্টগোল এর মাঝে কাজের কথাও চলছে । কোন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের কাজ শুরু করা যায়।  ইত্যাদি। সবাই সে আলোচনায় একে একে অংশগ্রহণ ক'রে তাঁদের বক্তব্য রাখছেন । দলের একজন মহিলা সদস্য  কেবল  তারই মধ্যে একটু যেন  নীরব।  সারাটা পথেই । সে নীলাঞ্জনা ।আমরা কথা বলার  ফাঁকে ফাঁকেই তাকে তাই দেখে নিচ্ছি ওর নামের সঙ্গে দুটি চোখের  সৌন্দর্যের কী গভীর সাদৃশ্য। শরীরে সে  হয়তো কিছুটা স্থুলকায় , অনেকটাই শ্যামবর্ণা।  সে কথা বলছে না তেমন ক'রে ।কিন্তু আলোচনায় প্রবেশ করছে বেশ সক্রিয়ভাবে। সময়ে সময়ে টুকিটাকি লিখিত তথ্য বা  সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তি তুলে ধরছে আমাদের প্রত্যেকের জ্ঞাতার্থে। আমাদের আলোচিত বিষয়গুলি  তৎক্ষণাৎ মন দিয়ে পড়ে নিয়ে , প্রত্যেককে  সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছে    ভুল ভ্রান্তিও । আর আমাদের কলরোলময়  কথাবার্তার মাঝে যে শূন্যস্থান থাকে , সেগুলি পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল নীলাঞ্জনার মহার্ঘ হাসিতে। নির্মল সেই হাসিতে আমরা হচ্ছিলাম স্নাত ,প্রাণিত ।
    ----- নীলাঞ্জনা, কথা বলছে না কেন ?
একজনের জিজ্ঞাসার প্রত্যুত্তরে নীলাঞ্জনার আবার সেই হাসি উপহার। যা স্বাভাবিক ভাবেই হয়ে উঠছিল
  যেন  বহু প্রশ্নের এককালীন নীরব উত্তর।
আমাদেরই এক প্রাজ্ঞ সদস্য বন্ধু হঠাৎই
   নীলাঞ্জনাকে এক লহমা দেখে নিয়ে নিজের মনে মনেই যেন বলে উঠলেন :
---- নীলাঞ্জনা র মধ্যে রয়েছে আত্মার সৌন্দর্য ।
-----আত্মার সৌন্দর্য ? সে আবার কী ? তা দেখতে পাওয়া যায়
  নাকি ?
আর এক বন্ধু র নিরুপায় প্রশ্ন।
----- অবশ্যই দেখা যায়। বাহ্যিক সৌন্দর্য তো অনিত্য।
  একসময় তা নিস্প্রভ , ম্লান হয়ে যায় ।আর আত্মার সৌন্দর্য হলো নিত্য । সেখানে অন্তর আত্মার পরিচয় পাওয়া যায়। যা মানুষকে বিকশিত করে ভিতরে ভিতরে । বাইরের স্থুল আকর্ষণ থেকে  তার স্থিতি অনেক দূরে ।
-----অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে
      নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে ।
-----হা,, ঋষি কবির প্রার্থনা তো ছিল তাই।শৈশব থেকেই প্রার্থনার দৈনন্দিন অভ্যাসে শিশু মন যেন উদভাসিত হতে শুরু করে । তবেই তো একটা সময় আসবে,যখন নির্মলতা, উজ্জ্বলতা, সৌন্দর্য সারা শরীরের শুধু বাহ্যিক অবয়বে নয়, অন্তরে বাহিরে ঝর্ণাধারায় ছড়িয়ে পড়বে সমানভাবে। অন্তর আর বাহির পৃথকভাবে তখন চিহ্নিত করা যাবে না। আর বলা বেশি, ভিতরের সৌন্দর্যই তো প্রকৃত সৌন্দর্য। যা দেখতে পাচ্ছি আমাদের নীলাঞ্জনার মধ্যে।
----- মন আর মুখ তখন একাকার হয়ে যায় ?
----হ্যা, মনের মালিন্য চলে গেলেই তো
  , তা এক পরিষ্কার দর্পণ। তাতে মুখও দৃশ্যমান হবে পূর্ণ অবয়বে । আত্মার জ্যোতিতে  তো জড়বস্তুর প্রকাশ ঘটে। তেমনি, সেই জ্যোতিতে যদি স্থুল শরীর হয় আলোকিত, আত্মার সব বৈশিষ্ট্যগুলো তা লাভ করে এবং নিত্যবস্তু রূপে তার প্রকাশ ঘটে সে  তখন খর্বকায় , কৃষ্ণকায়  না শীর্ণকায় এসব তুচ্ছ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্নোত্তরে এত সব ভারী ভারী
  কথা চললো দুই বন্ধুর মধ্যে ।  নীলাঞ্জনার সামনেই । নীলাঞ্জনা  নত মস্তকে ,  শোনে এইসব । হয়ে যায় যেন  সে আধেকলীন ।  কিন্তু হৃদয়ে দূরগামী।
এতদিন তবে কি আমরা চোখ মেলেছি শুধু বাহির পানে ?


নীলাঞ্জনাকে সামনে রেখে আমরা সেদিন তাকালাম  কিছুটা  হৃদয়পানে ।



সেদিনের সত্যজিৎ রায়


সত্যজিৎ রায়ের মতো অত বড়ো ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কিছু বলতে বা লিখতে গেলে সংকোচ হয় খুব কদিন আগেই তাঁর একটি ছবির শুটিং এর একটি অংশ দেখতে গিয়ে ভাবছিলাম এইসব সূত্রে যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁরা কী ভাগ্যবান !এক শিশু শিল্পীকে বারবার নির্দেশ দিচ্ছেন একটি মুহূর্তকে নিখুঁতভাবে অভিনয় করার জন্য । বিরক্তি তো নেই , শরীরের রুগ্নতা সত্ত্বেও কী আনন্দে কাজটি তিনি করে যাচ্ছেন ।
একবার তাঁর সঙ্গে আমার শুধু দেখা নয় কথাও হয়েছিল ।ভাবলে অবাক হই আজ।সবে বর্ধমান থেকে কলকাতা এসেছি । তিনি তখন খ্যাতির চূড়ায় । কিভাবে যেন আমন্ত্রণ পেয়ে তাঁর হীরক রাজার দেশে ছবিটির প্রিমিয়ার শো দেখতে গিয়েছি শিশির মঞ্চে । সঙ্গে দুজন বন্ধু । আর ছিলেন সেসময়ের দিকপাল একদল লেখক, সাংবাদিক, শিল্পীর দল।অপর্ণা সেন , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আরও কত যে জন ।
ছবি দেখার শেষে , বাইরে দাঁড়িয়ে একটু গল্পগুজব করে সবাই ফিরে যাচ্ছেন। সত্যজিৎ রায় , তাঁর গাড়ি এগিয়ে আসতেই , গাড়ির সামনের দরজা খুলে সবে বসেছেন।তিনি তো সামনে সিটে ড্রাইভারের পাশেই সর্বদা বসতেন । কী কারণে যেন গাড়িটির স্টার্ট নিতে দেরি হচ্ছিল । আমার হঠাৎ মনে হল এই সুযোগে আমি তো আমার কথাটা বলে নিতেই পারি !অনেকদিন ধরেই তাঁর কথাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু তাঁকে ধরাই তো কঠিন কাজ । কথাটি আর কিছু নয় । আমরা সেসময় আমার সম্পাদিত 'প্রতিবিম্ব' পত্রিকায় র প্রতি সংখ্যায় লেখক শিল্পীদের বইপড়া নিয়ে কিছু স্বীকারোক্তি প্রকাশ করছি । বর্ধমানে থাকাকালীন তা শুরু হয়েছিল ।কলকাতাতেও লেখকেরা অনেকেই খুব আগ্রহ প্রকাশ করায় বিভাগটি চলছিল বেশ। একেকটি সংখ্যার প্রকাশ ঘটে আর সবাই দেখে নেন কার কোন বই প্রিয় । আমাদের প্রশ্নগুলো ছিল অতীব সহজ ও সরল
আপনার প্রিয় দশটি বাংলা বই কী ?আপনার প্রিয় পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ কী ? দশটি বাংলা গল্পের একটি সংকলন করার দায়িত্ব পেলে কোন কোন গল্প নেবেন ?আর গত একবছরে আপনার পড়া উল্লেখযোগ্য বই বা রচনা কী ?বলছি বটে সহজ ছিল, অনেককে দেখতাম কী কসরতই না করছেন উত্তর দিতে গিয়ে । দিতে রাজিও হচ্ছেন না অনেকেই । নিকট বন্ধুদের ক্রোধের কারণও হতে চান না কেউ ।আবার কোনও কারণে না দেখিয়ে নীরব থেকে যান এমন লেখকদেরও দেখেছি  
সেদিন শিশির মঞ্চের বাইরে সত্যজিৎ রায় মশাইয়ের কাছে গিয়ে অতীব দ্রুততার মধ্যে ওই প্রশ্নগুলো কোনরকমে রাখতে পেরেছিলাম । সব শুনে তিনি তাঁর বিখ্যাত ব্যারিটোন স্বরে বললেন ,কত বই তো প্রিয় আছে । মাত্র দশটির নাম ? আমি তখন অকুতোভয় । পালাতে চাই না ।
আমি বলি ,দেখুন,জামা কাপড় কিনতে গিয়ে আমরা তো অনেক নমুনাই দেখি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিনি হয়ত একটি বা দুটি
তাহলে দশটি প্রিয় বইয়ের নাম বলতে অসুবিধা কী , বলবেন অনুগ্রহ করে ? আমাদের যে খুব প্রয়োজন আপনার মত একজন পাঠকের এই স্বীকারোক্তি । এখনও মনে আছে তিনি মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির দরজা খুলে নেমে এসে বললেন , "আপনার পরিকল্পনা টি ভারী ভালো। আপনি একদিন আসুন বাড়িতে । অবশ্যই ফোন করে ।''

বড়ো দুঃখের কথা । আমি আমার চিরকালীন ভালোবাসার আলস্যকে সরিয়ে রেখে আদৌ আর তাঁর বাড়িতে যেতে পারিনি ।শুধু তখন নয় , পরেও নয় ।এই গল্পটা এক সভায় বেশ নাটকীয়ভাবে বলি । সব শুনে আমাদের প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষ আমাকে বলেছিলেন আপনার যাওয়া উচিত ছিল । এ গল্পের এই পরিণতি হবে , ভাবিনি ।

আমি আজও ভাবি , সত্যিই তো , ওই প্রশ্নগুলির উত্তর সেদিন সংগ্রহ করে রাখতে পারলে , আমরা বাংলা বইয়ের উত্তম পাঠককুলের জন্য এক টুকরো মূল্যবান সম্পদ তো তুলে দিতে পারতাম ! তাই না ? বড়ো ভুল হয়েছে আমার । সত্যজিৎ রায় ফিল্ম নিয়ে , বিদেশি বই নিয়ে অনেক লেখা লিখেছেন , কিন্তু তাঁর পড়া বাংলা বই নিয়ে লেখা ? আছে কি ? জানি না ।

আর কে একথা অস্বীকার করবে যে ভালো বই হল সেই বন্ধু যা মানুষকে প্রতারণা করে না কখনোই ।বলিভিয়ার জঙ্গলে , শুনেছি চে গুয়েভারা একটা দোলনায় শুয়ে বসে দিনরাত
  শুধু গ্যয়টে পড়তেন। 


 

No comments

Powered by Blogger.