তীর্থদর্শন





রামচন্দ্র প্রামাণিক

তীর্থদর্শন



উনিশশো আটানব্বই কিম্বা নিরানব্বই। আমি তখন কলকাতার ন্যাশানাল ইন্সিওরেন্স কোম্পানির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা । প্রায়ই যেতে হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোম্পানির কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি বুঝতে । পুনের রিজিওনাল অফিসে একটি মিটিং ছিল। সেখানে শুনলাম পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর ভাগ্নে কাজ করেন ওই অফিসে। আমি তো রীতিমত চমৎকৃত। ডেকে আলাপ করলাম তাঁর সাথে।অত্যন্ত সদালাপী ওই মারাঠি ভদ্রলোক নিজেও একজন সংগীতজ্ঞ। কাছাকাছি অনুষ্ঠান হলে এবং সময়সুজগ মিললে তিনিও নাকি বসে পড়েন পণ্ডিতজীর পিছনে --- সারেঙ্গী হাতে।
আমার  উদ্ভাসিত চোখমুখ দেখে তিনি নিজে বললেন --- দেখা করবেন মামুর সাথে ? আমি জানতে চাইলাম সেটি সম্ভব হবে কীনা । এবং হলে --- কবে কখন? উত্তরে জানালেন পড়ে গিয়ে একটি পা ভেঙে সেই প্লাস্টার করা পা নিয়ে তিনি এখন শয্যাগত। পুনের বাড়িতেই আছেন।অসুস্থ মানুষকে বিড়ম্বিত করতে আমার দ্বিধা তিনি সহাস্যে উড়িয়ে দিলেন। ফোন করলেন মাতুলালয়ে।
সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ মিটিং মাথায় উঠল। অফিসারটি নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাকে নিয়ে চললেন তাঁর মাতুল পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর বাড়িতে।
প্রথমেই এক ঝলকের বিহঙ্গ দৃষ্টিতে কেমন দেখেছিলাম সেই বাড়িটা তা বলা দরকার।একটি বাড়ি বৃহৎ বাংলো , বেশ খানিকটা জমির মাঝখানে। অত বড়ো শিল্পী, অর্থাগমের সুজগ যার সুপ্রচুর , তাঁর ভদ্রাসন বলেই মনে হয় না।মেন গেট দিয়ে ঢুকলে মনেই হয় না অমন ভারতবিখ্যাত একজনের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। না বাগানে না বাড়িতে ------কোথাও সেই বৈভবের বিভূতি, চোখে পড়ার মতো চাকচিক্য।
সদরে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন প্রান্তযৌবন এক ভদ্রলোক ---- কপালে টিকাধারী টিপিক্যাল ব্রাহ্মণ ---- যিনি, পরে জানলা্‌ম, পণ্ডিতজির পুত্র ( সম্ভবত জ্যেষ্ঠ) ।

আমাকে তিনি তাঁর পিতার শয়নকক্ষে নিয়ে গেলেন। একটি নীচু খাটে প্লাস্টারকরা পা-খানি লম্বা লম্বা করে বাড়িয়ে পিঠে বালিশ দিয়ে তিনি আধশোয়া হয়ে রয়েছেন। খাটের পাশে একটি চেয়ার রাখা যেখানে বসে আছেন এক সাধারণদর্শন প্রায়বৃদ্ধা মহিলা—তাঁর স্ত্রী। অন্যদিকে রাখা শূন্য কাঠের চেয়ারখানি অতিথিদের জন্য যেখানে তিনি আমাকে বসতে বললেন। আমি যতক্ষণ ছিলাম তাঁর পুত্রটি দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝলাম সেটিই এই গৃহের রীতি।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। বিশাল শয়নকক্ষটির অনাভরণ গৃহশয্যা, আসবাবপত্র, খাট এবং বিছানার চাদর-বালিশ ইত্যাদি দেখে যে কেউ ভাববে এটি একটি রুচিসম্পন্ন মধ্যবিত্ত বাঙালী গৃহ। শুধু পার্থক্য এটাই যে দেয়াল ঘেঁষে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র রাখা।
পণ্ডিতজি এবং তাঁর স্ত্রীকে প্রণাম করলাম। মাথায় হাত দিয়ে তিনি আশীর্বাদ করলেন। আমাদের অফিসার তাঁর ভাগ্নে – যিনি মামাতো ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ---- আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পণ্ডিতজি স্বভাবসুলভ নিচু স্বরে কলকাতার খুব প্রশংসা করলেন। বললেন, প্রতিবার ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্সে তিনি সংগীত পরিবেশন করেন এবং খুব আনন্দ পান। এমন সমঝদার শ্রোতা অন্য কোন শহরে নেই। যখন শুনলেন যে আমিও সেই ডোভার লেন-এই থাকি এবং সেই সংগীত সম্মেলনের নিয়মিত শ্রোতা, তিনি খুশি হলেন খুব।
ইতিমধ্যে একটি তরুণ, গৃহভৃত্য বোধহয়, কক্ষটির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে --- ট্রে হাতে। পণ্ডিতজির পুত্র     ( নাম ভুলে গেছি ) এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে ট্রে-টি নিয়ে আমার সামনের নিচু চায়ের টেবিলটায় রাখলেন। প্লেটে সাজানো হরেকরকম মিষ্টান্নপণ্ডিতজি বললেন – খাও , খেতে খেতে গল্প হবে।
সেই ছেলেটি আবার এসে দাঁড়িয়েছে দরজার পেছনে। হাতে আর একটি ছোট ট্রে যাতে প্লেটের ওপর বসানো চায়ের কাপপণ্ডিতজির পুত্র এগিয়ে গিয়ে সেটিও নিয়ে এলেন এবং আমার সামনে রাখলেন চা-পান পর্ব অতিক্রান্ত হলে, লক্ষ করলাম, সেগুলো এবারও নিয়ে গেলেন পণ্ডিতজির জ্যেষ্ঠ পুত্র। দিয়ে এলেন দরজার সন্নিকটে দাঁড়ানো ছেলেটিকে। বুঝলাম এটিই ওই মহান শিল্পীর গৃহে প্রতিষ্ঠিত রীতি। অতিথিকে চা-জলখাবার দিয়ে আপ্যায়ন করবেন স্বয়ং গৃহকর্তা অথবা গৃহেরই অন্য কেউ। কাজের লোক কখনোই নয়।
পণ্ডিতজি যখন সংগীতবিষয়ক কথাবার্তায় ঢুকছেন , ত্রস্ত ভঙ্গিতে বললাম --- আমি একেবারেই অশিক্ষিত শ্রোতা। বরং আমার স্ত্রীর সামান্য ট্রেনিং আছে। আমি কেবল তার সাথি হিসাবে ভালবেসে এবং আগ্রহ নিয়ে শুনি --- এই পর্যন্ত। উনি তখন জিজ্ঞেস করলেন আমার স্ত্রী কার কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। সবিনয়ে বললাম, সেও কোন বিখ্যাত ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধে শেখেনি। তার শিক্ষাও সামান্য, অত্যন্ত অখ্যাত শিক্ষকের কাছে। তিনি গম্ভীরভাবে বললেন --- অখ্যাত হলেই সে শিক্ষক সাধারণ হবেন এমন কোন মানে নেই।
তিনি ইঙ্গিত করে কথ্য মারাঠিতে কিছু বললেন তাঁর ছেলেকে। ছেলে গিয়ে দেওয়াল-আলমারি থেকে গোটা দশেক ক্যাসেট নিয়ে এলেন ( তখন ক্যাসেটই ছিল ) এবং ক্যাসেটের কভারের কাগজগুলো বের করে পণ্ডিতজির হাতে এগিয়ে দিতে লাগলেন। ড্রয়ার থেকে বের করে দিলেন একটি কলমও। পণ্ডিতজি প্রত্যেকটির উপর যত্ন নিয়ে দস্তখত করলেন --- ‘ভীমসেন যোশী’।
অসুস্থ মানুষকে আর বিব্রত করা উচিত হবে না। আমার অফিসার ক্যসেটগুলো হাতে তুলে নিলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বললাম – আমি সামান্য মানুষ । তিনি মৃদু হেসে বললেন -ম্যায় ভি। আমি আবার বললাম – গান কখনো শিখিনি। গানের কিছুই বুঝি না। তবু আপনার গান শুনতে শুনতে মনে হয় যেন অনেক কিছু বুঝলাম। অল্পক্ষণের জন্য হলেও যেন স্বয়ং ঈশ্বরের স্পর্শ পেলাম। তিনি বললেন- এই জন্য কলকাতার মানুষদের এত ভালবাসি, এখানেই কেবল এরকম শ্রোতা আছে। একজন-দুজন নয় , অজস্র।
আর কখনও তাঁর সামনে যাইনি। যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তবে সেই একটি দিনের স্মৃতি আমার কাছে তীর্থদর্শনের পুণ্য স্মৃতি। তাঁর অন্য কিছু অনুকরণ করার সাধ্য তো আমার নেই। শুধু অতিথি এলে আমি এবং আমার স্ত্রী মনে রাখি --- আপ্যায়ন করবেন স্বয়ং গৃহকর্তা কিংবা গৃহকর্ত্রী ( দ্বিতীয় আর কেউ নেই আমার গৃহে ) কাজের লোক কক্ষনো নয়। এবং মনে রাখি তাঁর অযাচিত করুণা ---- অজ্ঞাত অখ্যাতর জন্য। তাঁর অমুল্য স্বাক্ষরযুক্ত ক্যাসেট কিন্তু আমি চাইনি। তিনিই দিয়েছিলেন উপযাচক হয়ে। একটি দুটি নয়। দশটি।

No comments

Powered by Blogger.