প্রীতম বসাক



স্বপ্নে পাওয়া ভ্রমণ
 
১.

গাধার পিঠে করে আমি দেশ আবিষ্কার করতে চাই স্টিফেনসন
একটা নদীতর গ্রামের জিহ্বায় নেমে যেতে চাই

পাখিরা যেভাবে আকাশ খুলে অনন্ত নিয়ে আসে 
দেখে ঘাসের সহজে প্রস্ফুটিত একটি জীবনের কথা 
গরীব লেখা  চুমু খায় কালো মেয়ের নিবিড়ে
মোষের লেজে ডিম পারে প্রকৃতি

দেখো হে মাধুর্য, চাঁদের শাড়ি পড়ে আছে  হেমন্ত নগরে
গাছেরা স্নেহগুচ্ছ দিয়ে ঢাকছে টিপ টিপ দুঃখ 

সন্তান প্রসবের পর ভরে উঠেছে মাঠের করুণা
আমি ওই  দুধ-স্নানে অবাক হতে চাই স্টিফেনসন
পাহাড় মাখতে চাই—পশমের প্রাচীন নিরিবিলি 





খৃষ্টপূর্বাব্দ কোন দেশে এসেছি স্টিফেনসন
এখনো কোন ধর্মভীরু মেঘ চোখে পড়েনি 

গাছেদের চরিত্র নিতান্তই সরল ও আদিম 
গাধার সঙ্গে তাদের কথা হচ্ছে চাঁদের ভাষায়

পাখিরা নদীতে ঠোঁট  মাজতে এসে
মাছেদের গর্ভের  ধারণায় ছায়া ফেলছে
আর খুব অবাক করে এসেছে চারদিকে

ফলগুলো গড়িয়ে আসছে ফকিরের দোয়া মেখে
কিন্তু আমার খিদা পাচ্ছে না স্টিফেনসন, ঘুমও না

আমি কি মানুষের মানুষ থেকে দূরে চলে এসেছি 






স্টিফেনসন দেখো পুকুরে স্নান করতে আসা ওই স্নেহময়ীকে
স্তনে এখনও লেগে আছে সন্তানের কামড়ের সুগন্ধ 
এই দৃশ্যের কাছে বসে থাকো আর বোঝ আমাদের সমূদয় 
অহম কেমন মুখ নরম করে দাঁড়িয়ে আছে 

একটি ব্যাকুলতাকে আমি দেখেছি গাছের পাতা 
জুড়ে জুড়ে ধ্রুপদি রচনা করতে
তুমিও দেখো স্টিফেনসন মানুষের অ্যালকেমি

এই তো জীবনানন্দ রঙের জামা পরা বালক 
আমার জন্য একবাটি ঘুম এনেছে 
কেমন ধোঁয়ামগ্ন বিছানা বালিশ 

স্টিফেন এই কি তবে নির্বাণের ময়ূর
একা একা শিরোনামহীন আয়ুতে ঠোঁট রাখা





অতিবৃষ্টির একটা জীবন পেছনে ফেলে এসেছি 
স্যাঁতসেঁতে চোখগুলো শুকোতে দিয়েছি পাখিবাচক মাঠে

আনন্দকে অনুসরণ করো স্টিফেনসন 
সৎ বাক্যের এই দেশে সমাধি নিই চলো
ভাতের অলৌকিকে বৃষ্টি আসবে মনে হয়

জলের কোন উপমা হয় না জেনে নেওয়ার পর
পাহাড়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় লোভের ব্যথা
আমলকী রঙের রোদে আঙুল ডুবিয়ে দেয় দুঃখী গাছ

আমি সেই দুঃখের শ্রদ্ধা  ছুঁতে চাই স্টিফেন 
ঠোঁটে যেন ভিক্ষালব্ধ হাসিটি ফুটে থাকে





স্টিফেনসন তাকিয়ে থাকো ওই কাঠবিড়ালির আনন্দে 
ওকে বুঝতে দিও না আমাদের ফলিত জ্ঞান  
চলো বসি ওই রসাল বৃক্ষের অজস্রতায়—রামপ্রসাদে 

একটি কবিতার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে দেখো
কীভাবে হিজাব পরা মেয়েরা  নিজেদের গড়িয়ে দিচ্ছে ফুটবলে
একটি রুগ্ন গল্পের স্তন কেমন দুধে দুধে অসীম 
ওকে ব্যথা দেওয়ার কথা চোখে এনো না 

বরং আমরা একটু পাতার টুপি বানানো অভ্যাস করি
মেষপালকের ওষ্ঠনির্মাণশিল্প এবং লিরিকের মুহ্যমান 

নতুন জনপদে আমাদের যেন যথেষ্ট ফকির মনে হয় 






তুমি কি মানুষের দেবতাকে নেড়েছো স্টিফেন—বঁধু  আমার
কিংবা দেবতার মধ্যে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে যে মানুষ—তার নাভী

তুমি কি সোনার জ্যোৎস্না সরিয়ে দেখেছো ভিতরের পুরুষোত্তম 
আগুনের কাছে  সুপথ যাঞ্ছা করো তবে, নমস্কার করো আশ্চর্যকে

কী আর করতে পারি আমি বলো অনুরোধের ডানা ছোঁয়া ছাড়া 
বলতে পারি শুধু জ্ঞান দাও জ্ঞান দাও বৃক্ষবাদকের
বলতে পারি হে কুঠারজীবী আমাকেই কাটো সরস মনে

স্টিফেনসন তুমি ভেবোনা এমন কোন দেশের কথা 
যেখানে মানুষের দুঃখ নেই তাপ নেই অসহ্য নেই 

আমাদের দেখা হওয়াটুকু বাচ্চারা পেখমে ধরে রাখবে জেনো






ইতস্ততের ভেতর থেকেই মানুষের শালিখ উড়ে যায় স্টিফেনসন
তুমি তাকে নভোমণ্ডলের সহজে বিবাহিত হতে দাও—সানাই হতে দাও

শুভ্র হাঁস এসে বসেছিল আমার মাছ জীবনের চোখ ঘেঁষে 
তাকে ঠোঁটে করে রোদের শরবত দিয়েছি, জলের জামা

অঙ্কের অধিক জটিল যে চোখ—কাব্যের অতি যে গান
তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য গাছে গাছে বিকেল টাঙাও
তবে না আমাদের মৌসুমীবায়ুর তাঁতকলে অযূত সুবস্ত্র হবে 
আর মেয়েদের পূর্ণতা দেখে হেসে উঠবে রাখালের আহার

স্টিফেন ওই দেখো আমাদের গাধার আশ্চর্য পিঠ 
একথালা পৃথিবীর দিকে ও কেমন কামরাঙা তাকিয়ে আছে 






কাল অবিকল হরিণ প্রজাতির মানুষ দেখেছি স্টিফেনসন 
ঘাসের নরমে হামাগুড়ি দিতে দিতে তারা ক্রমশ ঘাস হয়ে যাচ্ছিল 
ওদের লণ্ঠনগুলো থেকে গড়িয়ে নামছিল মৃদু জীবনধর্ম 
যেদিকে বহুকাল চলে গিয়েছে অমল নামের ঘোড়াগুলো

স্টিফেন তোমাকে বলিনি আমার প্রাচীন দিনলিপি 
বলিনি কীভাবে হারিয়েছি শ্রেষ্ঠ কবিতার সিরিজ 
বিশুপাগল রোগে খসে পড়া চুলের প্রমুখ

স্টিফেন, আমি খুঁজতে বেড়িয়েছি সেইসব আপেলবাগান 
বন্ধু, যেখানে আমাদের লামা জন্মের বালক পড়ে আছে

 




সব সত্য অর্ধেক খাওয়া আপেল- পড়ে আছে কলসের গভীরে
ভাষার মোহর তুমি কি পেয়েছো স্টিফেনসন—সোনালী নকুল

হে মার্জার, তুমি আমাদের দুঃখ এঁটো  করে চলে গেছো
পাকা পাকা আনন্দ তাই মাথা ব্যথা নিয়ে শুয়ে আছে 

আমি সেই সব ভেষজ মূল্যবোধ ঢুঁড়ে পেতে চাই স্টিফেন 
চিন দেশের লিপি উদ্ধার করতে পারা বৃদ্ধের কর্মকুশলতা বাঞ্ছা করি
কর্ষণের অভাবে মরে যায় যে বেদ আমি তার বুকে টিপকল হতে চাই

স্টিফেন, শোনো সন্ন্যাসীর মুখ থেকে উচ্চারিত  মহাকাশ 
শোনো শিশুর কান্নার আহ্বানে ফিরে আসা পিতাপুরুষের আহা

পুঁথি সংগ্রহে বেড়িয়ে আমরা যে এত প্রাচীন শোক পেলাম হনন  পেলাম
দেখো— তবু—তবুও জ্যোৎস্নার পেট থেকে কীরূপ অসংখ্য নদী নেমে আসছে




১০

দেখো স্টিফেনসন হাঁটতে হাঁটতে সভ্যতার ক্ষুর নিভে আসছে
চলো গাধার পায়ে নিরাময় ঢালি আর গোধূলি ধুয়েমুছে 
                                                    আখায় আঁচ দি—পাক করি

ঝোলা থেকে বেড় করে আনো প্রাপ্ত ফলাফল, আলাপচারিতা 
নারীর প্রফুল্ল বাক্—মানুষের হাত থেকে খসে যাওয়া নদনদী 
আধখাওয়া চাঁদ আর ঢাকা দেওয়া কান্না—পিপাসাময় অধর
পলেস্তারা খসা ঘুম আর নক্ষত্রপতন আর অসংখ্য প্রেত জিন

পাতো স্টিফেন অশ্রুপিঁড়ি, চিত্রকল্প,সেলাই করা দিবস-রজনী
আমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ ঋণ আছে – নমস্কার বাকি আছে

বিদায় ভাষণ দেওয়ার আগে আমরা পরস্পরকে বেড়ে দিই অনন্তে



No comments

Powered by Blogger.