সোনালী মিত্র

মুদ্রারাক্ষস

পুরনো পয়সা জমিয়ে নিজেকে রাজা সাজাবার

বাবার এক অদ্ভুত নেশা ছিল ।

সেইসব ধাতুর কয়েনের মধ্যে থেকে দুপুর গভীর হলে

বেরিয়ে আসতো সমুদ্র গুপ্তের সারঙ্গীর অলৌকিক রোশনি ,

পাল-সেনদের রক্তমাখা তরবারির সদর্প উল্লাস,অশোকের ধর্মস্ত্রোক।

 

বাবার শিরায় ছলকে উঠতো মৃত-জমিদারির ক্ষুধার্ত লোলুপ বাঘ

আমরা ভয়ে সিটিয়ে যেতাম মায়ের কোলে ।

বাবা বিপিএল কার্ডে চাল-গমের হিসেবের থলে নিয়ে ঢুকে

যেতেন পুরনো কয়েনের ভিতর ,উন্মাদগ্রস্থ নেশায়

একদিন রাজা হবেন বলে ।

আমরা বাবার বুকের মধ্যে শুনতে পেতাম ধাতব চিৎকার,

আফিম ক্ষেতের মধ্যে অসফল মানুষের নঞ্চর্থক সুরের গোঙানি ।

 

মায়ের শাক তোলার প্রবল নেশা ছিল

ভূতে পাওয়া মানুষের মতো ছুটে যেতেন খালেবিলে ।

বড় হয়ে বুঝেছিলাম , অভাবী মায়েরা আসলে জ্যান্তভূত , সন্তানের

পেট ভরাতে কোনও অবলম্বন পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন তার ওপরে ।

 

আমারও নেশা আছে সম্পর্ক গিলে খাওয়ার ।

অন্ধকারের মধ্যে খুন করে নিজের আত্মমুখ খাই ,

আর খেতে খেতে দেখি আমার শরীর থেকে মুছে যাচ্ছে ব্যক্তিগত চিত্র

বাবার দীর্ঘছায়া ঘন হচ্ছে আমার মুখের ওপরে ...

 

 

ক্যানভাস

পুটুস,আকাশ দেখে

আমি পুটসের বন্যসোহাগ দেখি

শ্যামলা গড়নে ভাঁজ-পড়া কোমরে অসংলগ্ন কাপড় খুঁজি

বুনোশূকরের মাংসের পোড়া ধোঁয়া,মহুয়ার যুবতীপূর্ণিমায়

পুটুস মাদিবাঘ হয়ে ওঠে , হিংস্র দাঁতে ছিঁড়ে খায় হাড়-মাংস

এইসব দেখি আর লুকোনো শিকারিদের মতো

ক্যানভাসে টুকে রাখি হরিণের বিশ্বাসী দৃষ্টি

 

পুটুসের মাটিবুকে নিটোল ডুমুরের-ফল আছে ,

আমি পুটুসের আদিমজঙ্গলের ঘাসপালা দেখি , চিবোই

চিবোনোর ফলসরূপ রস থেকে তৈরি হয় রং

রসের মহিমায় আমার ক্যানভাসে জেগে ওঠে এক প্রত্ননারী

জ্যোৎস্নাবনে সে এক অদ্বিতীয়া জ্যোৎস্না , সামান্য নখের আঁচড়ে

ভেঙে যায় সে

 

এগজিবেশন সৌন্দর্যের সমস্ত সার্চলাইটটুকু কেড়ে নেয় পুটুসমণি

আমি দর্শকের মুগ্ধতা ও নিলামের দর ধরে থাকি

কালো রং থেকে আমার পুটুসরানি কর্পোরেট সভ্যতার দিকে

হাঁটতে থাকে

পুটুসকে নিলামে তুলি শিল্পের প্রয়োজনে

পুটুসের কলে জল নেই , বিড়িপাতা পড়ে আছে দাওয়ায়         

 

 

অলাতচক্র 

ভয় লাগছে!

কড়ে আঙুলে আঙুল জড়িয়ে রাখ ,

শ্বাসের উত্থান পতনে পাশে থাক

দৃষ্টি থাকবে মোমবাতির স্থির রশ্মি ছুঁয়ে

ঠোঁট নড়বে হাল্কা , অনাদি সেই ভাষা

ডাকের মধ্যে প্রতিষ্ঠা থাকা চাই , সঙ্ঘ থাকা চাই

একাগ্রতায় বিলীন চাই

আসলে এই ছায়া ঠিক জীবনের মতো নয়

মৃত্যু ছুঁয়ে যাওয়া

বহুদূর থেকে ভেসে আসা ধূসর খন্ড খন্ড মেঘ...

হাতে নিতে গেলে জল হয়ে যায়

এক বুক শ্বাস টেনে দেখ , একবার নাভিস্পর্শ লিখে রাখ।

দেখ , শরীরের গন্ধ ভেবে চিনে নিতে পার কিনা!

আত্মার গন্ধ কি সব একই রকম হয়?

তখন চিনে নিতে পারবে তো আমায়!

তখন ডেকে ডেকে ফিরে যাবে না তো বিদেহী আত্মা আমার!!!!!!

 

 

                                                                                 ছবি - অর্ণব বসু

 

 

 

 

 

 

 

No comments

Powered by Blogger.